অতীশ সেন, ডুয়ার্স: বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোকে ঘিরে এই মুহূর্তে গোটা রাজ্যে উন্মাদনা চরমে। ক্লাব ও বারোয়ারি কমিটিগুলি শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কুমোরটুলির শিল্পীদের পাশাপাশি মণ্ডপ তৈরির কাজে যুক্ত শিল্পীরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টার কাজ করে চলেছেন। বড় বাজেটের পুজোগুলির উদ্বোধন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। বঙ্গবাসীর শারদীয়া এই উৎসবের প্রস্তুতির মাঝে উত্তরের পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স এক ভিন্ন রকমের উৎসবের জন্যও প্রস্তুত হচ্ছে। মূলত পাহাড় থেকে সমতলের নেপালী সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই সময় দুর্গাপুজোর সাথেই মেতে ওঠেন তাঁদের নিজস্ব আরেক উৎসবে। 'বড়া দশেইন' উৎসবের সপ্তমীর দিন আয়োজিত ব্যতিক্রমী উৎসবের নাম 'ফুলপাতি'। এরই সাথে শুরু হয়ে যায় তাঁদের এক গুচ্ছ ভিন্নধারার উৎসব-অনুষ্ঠান। 

 

কী এই ফুলপাতি উৎসব? জানা যায়- নেপালী ও গোর্খা সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা দুর্গাপুজোর সময় ১৫ দিন ধরে চলা ‘‌বড়া দশেইন’‌ উৎসব এর অংশ হিসেবে 'ফুলপাতি' অনুষ্ঠান করে থাকেন। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে এই 'বড়া দশেইন'। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন বাড়িতে বাড়িতে মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে তৈরি করা হয় বেদি। এই বেদিতে স্থাপন করা হয় ঘট। এই ঘটের ভেতর থাকা মাটিতে বার্লির বীজ রোপন করা হয়, এরই সঙ্গে বেদিতে ছিটিয়ে দেওয়া হয় ধান, ভুট্টা সহ অন্যান্য শস্যের বীজ। গোর্খা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী এই বেদী এবং ঘটেই 'মা ভবানী' তথা দুর্গা বিরাজ করেন। ঘটে রাখা বার্লির বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পর তাকে ‘‌জামারা’‌ বলা হয়। 'বড়া দশেইন'-এর সপ্তম দিন এই জামরার ঘটের সঙ্গে কলাবউ, আখগাছ, শিবের স্বরূপ বেল গাছ, ডালিম, ধান, হলুদ, আদা, অশোক, জয়ন্তী এই মোট নটি উপকরণ লাল কাপড় দিয়ে বেঁধে একত্রিত করা হয়। এগুলিকেই একত্রে ‘‌ফুলপাতি’‌ বলা হয়। নেপালী সমাজে সাধারণ মানুষেরা বিশ্বাস করেন এই নয়টি ফুল ও পাতা নয়টি দেবীর প্রতিনিধিত্ব করে। নেপালের রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহের আমল থেলে এই প্রথা জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহাসপ্তমীর দিন এই ফুলপাতিকেই পালকির আদলে কাঁধে করে নিয়ে আড়ম্বরের সঙ্গে বের করা হয় রঙিন শোভাযাত্রা। 

 

ফুলপাতি পরই বিজয়া দশমীর দিন থেকে শুরু হবে 'দশাই টিকা'। লক্ষ্মীপুজোর রাত থেকে নাচ গানের সাথে 'দেউসি-ভাইলো' অনুষ্ঠিত হয়, এটি এক ধরনের নেপালী লোকগান। সাধারণত মহিলারা 'ভাইলো' পরিবেশন করেন এবং পুরুষেরা পরের দিন থেকে 'দেউসি' পরিবেশন করেন। লক্ষ্মীপুজোর মধ্য দিয়ে দশেইন উৎসব শেষ হয়ে গেলেও এর পর কার্তিক মাসে দীপাবলির দুই দিন আগে থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী দুই দিন পালিত হবে 'তিহার' উৎসব। এই উৎসবের পাঁচ দিনে চারটি আলাদা আলাদা প্রাণীর উদ্দেশ্যে পুজো করা হয়। প্রথম দিন কাক, দ্বিতীয় দিন কুকুর, তৃতীয় দিন গরু, চতুর্থ দিন ষাঁড় এই চারটি প্রাণীর পুজো করা হয় এবং এই দিন গুলিকে সেই প্রানীদের নাম অনুসারে কাক তিহার, কুকুর তিহার প্রভৃতি বলা হয়। পঞ্চম দিন পালিত হয় 'ভাই টিকা'। যা রাজ্যের অন্যান্য এলাকায় ভাইফোঁটা নামে পরিচিত। 

 

আজ মহাসপ্তমী, এদিন বিকেল থেকেই দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং, শিলিগুড়ি সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন শহরে আড়ম্বরের সাথে বের হয় শোভাযাত্রা। দুর্গোৎসবের পাশাপাশি ভিন্ন ধারার এই দীর্ঘ অনুষ্ঠানে মেতে উঠবে নেপালী সম্প্রদায়ের মানুষ।