আজকাল ওয়েবডেস্ক: "আমি তরুণ। আমি একজন মুসলমান। আমি একজন গণতান্ত্রিক সমাজবাদী। আমি এইগুলোর জন্য একটুও ক্ষমাপ্রার্থী না।" ৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানির এই ঘোষণাই আজ যেন এক যুগের প্রতীক—যেখানে বিশ্বজুড়ে বামপন্থা হিমশীতল, আর দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ‘নতুন স্বাভাবিকতা’য় পরিণত। তবু নিউ ইয়র্কের রাজনীতির আকাশে মামদানি যেন এক লাল বজ্রপাত—যিনি অভিবাসী, মুসলমান, শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবেই গড়েছেন নিজের বিজয়।
পুঁজিবাদের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তাঁর এই সাফল্য আজ আলো ফেলছে ৯,০০০ মাইল দূরে কলকাতার আকাশেও। প্রশ্ন উঠছে—জোহরান মামদানি যা পারলেন, ২০২৬-এর ভোটে সিপিএম কি পারবে সেই ‘মামদানি মুহূর্ত’ তৈরি করতে?
নতুন যুগের বামপন্থা: শ্রেণীর রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়ের সংযোগ
সিপিএম নেতা সৃজন ভট্টাচার্য মনে করেন, মামদানির সাফল্যের মূল রহস্য এখানেই— “২১ শতকের বামপন্থা কেমন হওয়া উচিত তা বুঝতে হলে মামদানির ক্যাম্পেইন খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা। এখানে শ্রেণীর প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি আত্মপরিচয়ের রাজনীতির দাবিও আছে। চামড়ার রং, অভিবাসন, ধর্ম—এই নিপীড়নের প্রশ্নগুলো বামপন্থা নতুনভাবে ধরেছে।”
মামদানি কেবল অর্থনৈতিক সমতার লড়াই করছেন না, তিনি একইসঙ্গে লড়ছেন আত্মপরিচয়ের মর্যাদা রক্ষার লড়াইও। শ্রেণী আর পরিচয়ের এই মেলবন্ধন—একই সঙ্গে মার্ক্সবাদ ও সামাজিক ন্যায়বোধের পুনর্মিলন—তাঁর রাজনীতিকে আমেরিকার নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। সৃজন মনে করেন, এটাই আজ ভারতের বামপন্থার বড় শিক্ষণীয় দিক। “আরএসএস ও বিজেপি আমাদের অনুপস্থিতিকে ব্যবহার করেছে। তারা গিয়ে আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘুদের বলেছে—‘তোমাকেও সহি হিন্দু হতে হবে’। ওরা appropriation-এর রাজনীতি খুব ভাল পারে। কিন্তু এখন ওদের প্রকল্প ধরা পড়ছে। সংবিধান আক্রমণের ফলে নিপীড়িত মানুষ বুঝতে পারছে—ওরা তাদের পক্ষে নয়, বরং বিপক্ষে।”
তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে দূরত্ব: সিপিএমের আত্মসমালোচনার মুহূর্ত
ভারতের রাজনীতি যখন ডানদিকে সরে যাচ্ছে, তখনও তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে ধারালো প্রতিরোধ গড়েছে—CAA আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্রদের প্রতিবাদ—সব জায়গাতেই তারা ছিল সামনের সারিতে।
সৃজন এই বাস্তবতা স্বীকার করেন নিঃসংকোচে: “আমাদের একসময়ের কার্যপদ্ধতিতে তরুণদের সঙ্গে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। তবে এখন সেটা মেটানোর চেষ্টা চলছে। শুধু নতুন মুখ নয়, ভাষা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, যোগাযোগ—সব কিছু পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।”
বামপন্থী সংগঠনের এই আত্মসমালোচনা আজ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মোদি যুগে রাজনীতির ভাষা বদলে গেছে। মিডিয়া, বিজ্ঞাপন ও সিনেমা মিলে গড়ে তুলেছে এক ‘অতিপুঁজিবাদী স্বপ্নরাজ্য’, যেখানে মধ্যবিত্ত মানুষও বিলাসের কল্পনা দেখতে শিখেছে, অথচ বাস্তবে তার আয় কমছে, চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। সৃজন বলেন, “আমরা এই আকাঙ্ক্ষা বনাম বাস্তবতার ফাঁকটা ধরতে পারিনি। আর সেই সুযোগ নিয়েছে দক্ষিণপন্থীরা—তারা বলেছে, মোদিই তোমার স্বপ্নপূরণের উত্তর। এখন আমাদের সেই মিথ ভাঙতে হবে।”
মামদানির জয়: বিশ্ব-বামপন্থার জন্য এক প্রেরণা
জোহরান মামদানি যখন ট্রাম্পপন্থী রাজনীতিকে পরাস্ত করেন, তখন তাঁর জয় ছিল শুধু এক ব্যক্তির নয়—এটা ছিল শ্রমিক, সংখ্যালঘু ও অভিবাসীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের জয়। তিনি ঘোষণা করেছিলেন— “আমি মুসলমান, আমি অভিবাসী, আমি সমাজবাদী—এবং আমি এর কোনোটির জন্যই ক্ষমাপ্রার্থী নই।”
এই ভাষা আজ বাংলার তরুণ বাম নেতাদের কাছেও এক অনুপ্রেরণা। সৃজন ভট্টাচার্যের মতে, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের রুটিরুজির প্রশ্নকে নতুন ভাষায় হাজির করা। মোদির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আমরা সমানাধিকার, কাজ, শিক্ষা—এই বাস্তব লড়াইগুলিকে সামনে আনতে চাই।” তাঁর মতে, এই প্রজন্মের কাছে বামপন্থা মানে শুধু অতীত নয়, বরং এক নতুন মানবিক রাজনীতি—যা শ্রেণী সংগ্রামকে যুক্ত করছে আত্মসম্মান ও পরিচয়ের প্রশ্নের সঙ্গে।
২০২৬: সিপিএমের রাজনৈতিক অস্তিত্বের পরীক্ষার বছর
৩৪ বছরের শাসনের পর আজ যখন সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শূন্য, তখন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন তাদের কাছে কেবল ভোটের লড়াই নয়—এক আদর্শিক পুনরুত্থানের পরীক্ষা। সৃজনের কণ্ঠে আশাবাদ স্পষ্ট: “আমরা আশাবাদী। মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন নিয়ে নতুনভাবে, নতুন অবয়বে বামপন্থাকে হাজির করছি। আশা করছি ফলও ভালো হবে।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সিপিএম যদি আগামী নির্বাচনে ১০ থেকে ১৫টি আসনেও প্রত্যাবর্তন করতে পারে, সেটাই হবে এক প্রতীকী পুনর্জন্ম—একটি নতুন বাম-পর্বের সূচনা। তাদের সাফল্য নির্ভর করবে, কতটা তারা তরুণ, নারী, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক সমাজের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারে।
ইতিহাসের অবসান? না পুনরুত্থান?
মামদানি প্রমাণ করেছেন—পুঁজিবাদের আঁতুড়ঘরেও লাল পতাকা ওড়ানো যায়। তিনি দেখিয়েছেন—শ্রেণী ও পরিচয়ের প্রশ্ন মেলাতে পারলে, বাম রাজনীতি আবারও মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ বাম নেতৃত্ব এখন সেই পাঠই আত্মস্থ করছে। তারা বিশ্বাস করে, মার্ক্সের অর্থনীতি, আম্বেদকরের সমতা আর আধুনিক সমাজবাদের মানবিকতা মিলিয়েই তৈরি হবে ২১ শতকের ভারতীয় বাম রাজনীতি। এবং সেই পথে এগোনোর আহ্বানই আজ সৃজনদের।
