আজকাল ওয়েবডেস্ক: শান্তিনিকেতনের প্রতীচীতে ফিরে বৃহস্পতিবার এক আন্তরিক অভ্যর্থনার মধ্যে দিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও চিন্তানায়ক অমর্ত্য সেন জানালেন, ভারতের যে কোনও প্রান্তে যদি কোনও অঞ্চলের মানুষের প্রতি অবহেলা বা নিপীড়ন ঘটে, তা অত্যন্ত গুরুতর বিষয় — এবং এর প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া উচিত। “এটা শুধু বাঙালিদের ব্যাপার নয়,” বলেন ৯১ বছর বয়সী ভারতরত্ন প্রাপ্ত এই অর্থনীতিবিদ। “ভারত একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র। যদি কোনও রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে হেনস্তার শিকার হন, তাহলেও আপত্তির যথেষ্ট কারণ থাকে।” বোলপুর মহকুমা শাসক অয়ন নাথ ও এসডিপিও রিকি আগরওয়ালের নেতৃত্বে প্রশাসনের তরফে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। সূত্র অনুযায়ী, আগামী ১৯ আগস্ট পর্যন্ত অমর্ত্যবাবু প্রতীচীতে থাকবেন, তবে এখনই তাঁর কোনও প্রকাশ্য কর্মসূচি নির্ধারিত নেই।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে অমর্ত্য সেন বলেন, “এটা কেবল কোনও এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সমস্যা নয়। ওড়িশার কেউ যদি রাজস্থানে অত্যাচারিত হন, তাহলেও আমাদের প্রতিবাদ জানানো উচিত। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে — ভারতের প্রতিটি নাগরিকের গোটা দেশের উপর অধিকার আছে। এটা কোনও আঞ্চলিক অধিকারের প্রশ্ন নয়।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও প্রতিক্রিয়া দেন অধ্যাপক সেন। “বাংলা ভাষা এক বিশেষ ঐতিহ্যের বাহক। চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো কবিদের লেখায় এই ভাষার মহিমা ছড়িয়ে রয়েছে। এ ভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করা মানেই এক ঐতিহাসিক অবজ্ঞার সূচনা করা। এই অবজ্ঞা প্রতিহত করতেই হবে।”

আরও পড়ুন: প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র স্বীকৃতি নিয়ে ফ্রান্স-সৌদি সম্মেলন: ব্রিটেনের অবস্থান ঘিরে জল্পনা, আমেরিকা-ইজরায়েলের তীব্র বিরোধিতা

প্রসঙ্গত, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অন্য রাজ্যে নির্যাতনের অভিযোগকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি শান্তিনিকেতন থেকে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। অমর্ত্য সেন সরাসরি কোনও রাজনৈতিক মন্তব্য না করলেও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। “প্রত্যেক নাগরিকের সম্মান পাওয়া উচিত। বিশেষ করে দেশের মানুষকে মর্যাদা দেওয়া এবং তাঁদের অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য,” বলে তিনি মন্তব্য করেন। “ভারতের যেকোনও নাগরিকের উচিত সুখ ও সংযুক্তির সঙ্গে জীবনযাপন — সেটাই আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তি।” এভাবে শান্তিনিকেতনের মাটিতে দাঁড়িয়ে অমর্ত্য সেন ফের একবার জাতিগত সংহতি ও মানবাধিকারের পক্ষে স্পষ্ট বার্তা দিলেন।

অমর্ত্য সেন শুধু অর্থনীতির ময়দানেই নয়, নাগরিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রশ্নেও দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতায় আরও জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর মতে, হিন্দু ধর্ম এক বহুত্ববাদী, সহিষ্ণু ও আত্মসমালোচনামূলক পরম্পরার ধারক — যার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্তমান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, যা ধর্মকে সংকীর্ণ জাতিগত পরিচয়ে পরিণত করছে।

তিনি বারবার বলেছেন, বর্তমান শাসকেরা ‘হিন্দু ধর্ম’-এর নামে যেটা চালাচ্ছে, তা আসলে সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ মতবাদ, যা ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। এনআরসি-সিএএ ইস্যু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার চেষ্টায়, সেন তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ধর্মীয় বিভাজনের এই রাজনীতি ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রের চেতনাকে আঘাত করছে, এবং এ বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক প্রতিরোধ অপরিহার্য।