ভারতীয় চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের এক বিশিষ্ট তারকা, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ভি. শান্তারামের স্ত্রী, বর্ষীয়ান অভিনেত্রী সন্ধ্যা শান্তারাম প্রয়াত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। মূলত বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর এই প্রয়াণে মুম্বই তথা গোটা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সন্ধ্যা শান্তারাম তাঁর অভিনয় জীবন এবং নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে একসময় হিন্দি ও মারাঠি সিনেমার দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ভি. শান্তারামের বেশ কিছু কালজয়ী চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেত্রী, এবং তাঁর শিল্প-যাত্রায় স্বামীর দূরদর্শী পরিচালন তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ভারতীয় সিনেমার ‘গোল্ডেন এরা’ বা স্বর্ণালী অধ্যায়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, যেখানে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি চলচ্চিত্রের মানকে আরও উন্নত করেছিল।
অভিনেত্রী হিসেবে সন্ধ্যা শান্তারামের পরিচয় তাঁর অভিনীত দুটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত— 'দো আঁখেঁ বরা হাত' এবং 'পিঞ্জরা'। 'দো আঁখেঁ বরা হাত' (১৯৫৭) এই চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র ভারতীয় সিনেমার নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল কারাগারের ছয়জন ভয়ঙ্কর বন্দীকে নিয়ে এক মানবিক গল্প, যাঁদের একজন আদর্শবাদী জেলার (ভি. শান্তারাম অভিনীত) সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এই ছবিতে সন্ধ্যা শান্তারাম 'চম্পা' চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি একজন স্থানীয় লোকনৃত্যশিল্পী ছিলেন। তাঁর অভিনয় এবং বিশেষ করে ছবির বিখ্যাত গান 'অ্যায় মালিক তেরে বন্দে হাম'-এ তাঁর নৃত্য পরিবেশনা আজও ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম আইকনিক দৃশ্য। এই ছবিটি বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে 'সিলভার বিয়ার' পুরস্কার এবং 'গোল্ডেন গ্লোব' পুরস্কার লাভ করে, যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় সিনেমার মুখ উজ্জ্বল করেছিল।

'পিঞ্জরা' ১৯৭২ সালে মারাঠি ভাষায় নির্মিত হয় এবং পরে হিন্দিতে মুক্তি পায়। এই ছবিটি ছিল সমাজের নৈতিকতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত এক শক্তিশালী আখ্যান। একজন আদর্শবাদী স্কুল শিক্ষক (ড. শ্রীরাম লাগু) এবং এক 'তামাশা' (মারাঠি লোকনৃত্য) শিল্পীর (সন্ধ্যা অভিনীত) জীবনকে কেন্দ্র করে এই গল্প আবর্তিত হয়েছিল। ছবিতে সন্ধ্যা শান্তারামের চরিত্রটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং, যেখানে তিনি একাধারে প্রেমিকা, নর্তকী এবং সামাজিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা এক নারীকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চলচ্চিত্রটির গান ও গল্পের গভীরতা তাঁকে একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন এই প্রবীণ অভিনেত্রী। যদিও তাঁর মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সরকারি বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে বয়সজনিত সমস্যাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কারণ।
অভিনেত্রীর প্রয়াণের পর মুম্বইয়ের শিবাজী পার্কের বৈকুণ্ঠ ধামে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়, এবং বহু গুণমুগ্ধ অনুরাগী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন।
সন্ধ্যা শান্তারামের প্রয়াণ ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করল। তিনি কেবল একজন অভিনেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিল্পী, যিনি তাঁর প্রতিভার মাধ্যমে ভি. শান্তারামের শিল্প-সৃষ্টিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন। তাঁর অভিনীত প্রতিটি চরিত্র, তাঁর নৃত্যশৈলী এবং তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট গভীর মানবিক আবেদন তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
