আজকাল ওয়েবডেস্ক: মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর ওরফে সাধ্বী প্রজ্ঞা-সহ সাত অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে দিল মুম্বইয়ের বিশেষ এনআইএ আদালত। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিতও। বৃহস্পতিবার রায় দেওয়ার সময় আদালত জানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পেশ করা হয়েছে তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। 

২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের নাশিকের মালেগাঁওয়ে একটি জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণে ছয় জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ৯৫ জন। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মামলা চলার পর বৃহস্পতিবার রায় দিল আদালত। অভিযোগ ছিল, বোমাটি একটি মোটরসাইকেলে রাখা ছিল। মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা (এটিএস) মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সাধ্বী প্রজ্ঞা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিতকে। অভিযোগ ছিল, মসজিদের পাশে থাকা  যে মোটরবাইক বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়েছিল, পরিকল্পনা করেই দুটি বোমা মজুত রাখা হয়েছিল তাতে, তা সাধ্বীর নামেই ছিল। প্রসাদ পুরোহিত সাধ্বীকে গোটা ঘটনায় সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। তবে, বৃহস্পতিবার এনআইএ আদালত রায় দিয়েছে যে সরকারি পক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে বাইকেই বোমা রাখা হয়েছিল।

বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে ভারতের প্রথম জঙ্গি হামলা বলে দাবি করা হচ্ছিল, যার সঙ্গে সাধ্বী প্রজ্ঞা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিত সহ সাত জনের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। এই সাত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালের বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে অভিযোগ আনা হয়েছিল। এটি দেশের সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা সন্ত্রাসী মামলাগুলির মধ্যে অন্যতম।

কী হয়েছিল ২০০৮ সালে?

২০০৮ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর মুসমিল অধ্যুষিত মালেগাঁওয়ে বিস্ফোরণটি ঘটে। রমজান মাস হওয়ায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা উপবাস পালন করছিলেন সেই সময়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সন্দেহ করা হচ্ছিল যে বিস্ফোরণের সময় হিসেবে মুসলিমদের পবিত্র মাসটিকে বেছে নেওয়ার কারণ এর পরের মাসেই হিন্দুদের নবরাত্রি উৎসব ছিল। এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধর্মীয় হিংসা তৈরির পরিকল্পনা ছিল।

স্থানীয় পুলিশ প্রথমে তদন্তে শুরু করে। পরে তা মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখার হাতে তুলে দেওয়া হয়। যদিও প্রথমে দাবি করা হয়েছিল যে বিস্ফোরমে ১০১ জন আহত হয়েছিলেন। কিন্তু এনআইএ কোর্ট জানিয়েছে যে আহতের সংখ্যা ৯৫। 

আরও পড়ুন: বিস্ফোরণ-হাহাকার-মৃত্যু, সতেরো বছর আগের মালেগাঁও মামলায় বেকসুর খালাস সাধ্বী-সহ সাত

মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখার তদন্তে কী জানা যায়

তদন্তে নেমে এটিএস সন্দেহ করে যে, একটি বাইকে আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস)রাখা ছিল। সেখান থেকেই বিস্ফোরণ। বাইকটির রেজিস্ট্রেশন নম্বরও ভুয়ো ছিল। এমনকি ইঞ্জিনের নম্বর এবং চ্যাসি নম্বরও মুছে ফেলা হয়েছিল। 

বিস্ফোরণে ব্যবহৃত বাইকটি তথ্য উদ্ধারের জন্য সেটিকে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়। ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে পেয়ে তদন্তকারী সংস্থাটি জানায় যে বাইকটির মালিক ছিলেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর। তাঁকে ২৩ অক্টোবর, ২০০৮ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুই সপ্তাহ পরে এটিএস অন্য অভিযুক্তদের-সহ মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা সকলে মিলে অভিনব ভারত নামক একটি গোষ্ঠীও তৈরি করেছিলেন বলে অভিযোগ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের মহারাষ্ট্র সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে চার্জশিট পেশ করা হয়। চার্জশিটে এটিএস দাবি করে যে তাদের বিশ্বাস মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহার বশে এই জঙ্গি কার্যকলাপ সংগঠিত হয়েছিল।

মামলার দায়িত্ব পেল এনআইএ

২০১১ সালে মামলার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র হাতে। এনআইএ যখন তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন অভিযুক্তরা তাঁদের বিরুদ্ধে আনা এটিএস-এর অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হন। ২০১৬ সালে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করে এনআইএ। সেই চার্জশিট থেকে এটিএস-এর আনা ধারাটিকে বাদ দেওয়া হয়। এনআইএ বলেছে যে এটিএস যেভাবে সংগঠিত অপরাধ আইন প্রয়োগ করেছে তা প্রশ্নাতীত নয়। এনআইএ চার্জশিটে আরও দাবি করে যে, প্রজ্ঞা ঠাকুরের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ জোগাড় করা হয়েছিল সেখানে অনেক ফাকফোঁকর ছিল এবং মাত্র সাত জনের বিরুদ্ধেই প্রমাণ মিলেছে, ১১ জনের বিরুদ্ধে নয়। তদন্তকারী সংস্থা আরও জানায় বাইকটি প্রজ্ঞার নামে নথিভুক্ত করা থাকলেও সেটি কালসাংরার জিম্মায় ছিল এবং বিস্ফোরণের আগে বাইকটি তিনিই ব্যবহার করেছিলেন।

এনআইএ আরও দাবি করেছিল যে, এটিএসের মামলাটি স্বীকারোক্তির উপর নির্ভর করে খাঁড়া করেছিল। যা আদালতে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। তবে এটিএস তাড়াহুড়ো করে সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করেছিল।

এনআইএ প্রজ্ঞা ঠাকুরের নাম বাদ দিতে চেয়েছিল

এনআইএ প্রজ্ঞা ঠাকুরের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানালে বিশেষ আদালত বলেছিল যে বিস্ফোরণের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই, প্রজ্ঞার এই দাবি মেনে নেওয়া কঠিন। আদালত যদিও এনআইএ-এর পরামর্শ মেনে নিয়েছিল যে মামলায় সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা প্রয়োগ না করতে। তবুও আদালত বলেছে যে সাতজন অভিযুক্ত- সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুর, প্রসাদ পুরোহিত, রমেশ উপাধ্যায়, সমীর কুলকার্নি, সুধাকর ওঙ্কারনাথ চতুর্বেদী, অজয় রাহিরকর এবং সুধাকর দ্বিবেদীরা ইউএপিএ, আইপিসি এবং ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক পদার্থ আইনের অধীনে বিচারের মুখোমুখি হবেন।

প্রমাণের অভাবে আদালত শিবনারায়ণ কালসাংরা, শ্যামলাল সাহু এবং প্রবীণ তাকালকিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। আদালত আরও জানিয়েছিল, দুই অভিযুক্ত রাকেশ ধাওড়ে এবং জগদীশ মাত্রেকে কেবল অস্ত্র আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

মালেগাঁও মামলার বিচার

২০১৮ সালে মুম্বইয়ে এনআইএ-র বিশেষ আদালতে সাত অভিযুক্তের বিচার শুরু হয়। চলে ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত। অভিযোগগুলির মধ্যে ছিল ইউএপিএ ধারা ১৬ (সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটন) এবং ১৮ (সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটনের ষড়যন্ত্র) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা, যার মধ্যে রয়েছে ১২০ (খ) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র), ৩০২ (হত্যা), ৩০৭ (হত্যার চেষ্টা), ৩২৪ (স্বেচ্ছায় আঘাত করা) এবং ১৫৩ (ক) (দু'টি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতার প্রচার করা)।

সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনআইএ তাদের চূড়ান্ত বক্তব্যে জানিয়েছিল যে মালেগাঁও বিস্ফোরণটি ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশকে আতঙ্কিত করার, প্রয়োজনীয় পরিষেবা ব্যাহত করার, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিঘ্নিত করার জন্য সংঘটিত হয়েছিল।