আজকাল ওয়েবডেস্ক:  সদ্যপ্রকাশিত আত্মজীবনী "Unknown Facets of Rajiv Gandhi, Jyoti Basu, Indrajit Gupta"–তে প্রাক্তন সিবিআই প্রধান ও রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজিপি অরুণ প্রসাদ মুখার্জি এমন এক ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশ করেছেন, যা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিতে পারত। মুখার্জির দাবি, ১৯৯০ এবং ১৯৯১ সালে দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে রাজীব গান্ধী জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করতে দু’বার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু দুইবারই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরে ১৯৯৬ সালে যখন তৃতীয়বার বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনও পার্টি তা নাকচ করে। জ্যোতি বসু নিজে পরে এটিকে "ঐতিহাসিক ভুল" আখ্যা দেন।

মুখার্জির মতে, রাজীব গান্ধী ১৯৯০ সালে যখন ভিপি সিং সরকার পতনের মুখে, তখন বিকল্প প্রধানমন্ত্রী খুঁজছিলেন। তাঁর তালিকায় প্রথমেই ছিলেন জ্যোতি বসু। দ্বিতীয় পছন্দ ছিলেন দেবীলাল এবং তৃতীয় চন্দ্রশেখর। মুখার্জি বলেন, "রাজীব গান্ধী আমাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেন জ্যোতি বসুর সঙ্গে বৈঠক আয়োজনে সাহায্য করতে। আমি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিশেষ সচিব।" জ্যোতি বসু রাজীবের ইচ্ছাকে সম্মান জানালেও স্পষ্ট করেন, পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। পার্টি শেষ পর্যন্ত রাজীবের প্রস্তাবে সায় না দিলে, চন্দ্রশেখর কংগ্রেসের বাইরে থেকেও প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসেই তাঁর সরকার ভেঙে পড়ে।

এরপর ১৯৯১ সালে পরিস্থিতি আরও একবার ঘুরে দাঁড়ায়। চন্দ্রশেখরের ব্যর্থতার পর আবারও রাজীব গান্ধী মুখার্জিকে বলেন, “আমি চাই বসুই প্রধানমন্ত্রী হোন, অন্তত এক বছরের জন্য।” মুখার্জি বলেন, “আমি রাজীবকে আশ্বস্ত করি আমি প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারি, যদি তিনি সত্যিই প্রতিশ্রুতি দেন।” কিন্তু আবারও একই বাধা—সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বসু সম্মতি দিলেও পার্টির অবস্থান একই থাকে। এই বিষয়ে মুখার্জি লেখেন, “বাম নেতৃত্ব আমার যুক্তিগুলি বুঝতেই চায়নি। আমি তাদের বোঝাতে চেয়েছিলাম, এই সিদ্ধান্ত শুধু বামপন্থার স্বার্থে নয়, গোটা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের অদূরদর্শিতা এবং গোঁড়ামি সব নষ্ট করল।”

 আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী সালাউদ্দিন ‘ঘোষিত পলাতক’, শ্রীনগরের বিশেষ এনআইএ আদালতের নির্দেশ

এরপর ১৯৯৬ সালে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার পতনের পর ইউনাইটেড ফ্রন্ট জ্যোতি বসুর নাম প্রস্তাব করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এই সময় লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু প্রমুখ বসুর নেতৃত্বে আস্থা রাখেন। কিন্তু সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি আবার ‘না’ বলে দেয়। বসু পরে বলেন, “এটি একটি ঐতিহাসিক ভুল।” সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন, বলেন, “এই ঘটনাগুলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের চরম দুর্ব্যবহার। আমি ব্যক্তিগতভাবে জ্যোতি বসুর মন্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত—এটা ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’। ইতিহাস অন্যভাবে লেখা যেত যদি পার্টি সে সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিত।”

শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “আমি এইসব তথ্য জানতাম না, তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে বিষয়টি ভাবনার।” মুখার্জি আরও লেখেন, “যখন হরকিষণ সিং সুরজিত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তখন কংগ্রেসের সঙ্গে একটি ন্যূনতম নীতিগত সমঝোতা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে পারমাণবিক চুক্তির মতো ইস্যুতে সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আজ পর্যন্ত কেউ জানে না, সেই বিরোধিতার আদৌ কী লাভ হয়েছে?” অবসরের পরেও মুখার্জি তিন নেতার (রাজীব, বসু ও গুপ্ত) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “তাঁরা আমাকে বিশ্বাস করতেন, কারণ জানতেন আমি নিরপেক্ষ এবং সৎ। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।”

রাজীব গান্ধীর ‘ভদ্রতা’, বসুর ‘অবিচলতা’ এবং ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর ‘সোজাসাপ্টা’ মনোভাবের প্রশংসা করেন মুখার্জি। তাঁর মতে, যদি জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ও নীতিনির্ভর হতো। আজকের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার অনেক শিকড় হয়তো তখনই উপড়ে যেত। এই বই প্রকাশের পর থেকেই সিপিএমের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক আলোচনায় ঝড় উঠেছে। বাম নেতৃত্বের ‘ব্লান্ডার-প্রুফ’ মনোভাব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—যেখানে সুযোগ হাতছাড়া করে আজ দলটাই হয়ে উঠেছে রাজনৈতিকভাবে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক।

সিপিএমের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে এক অলিখিত ‘কেরল বনাম বাংলা’ দ্বন্দ্ব সক্রিয় ছিল—বিশেষত, পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শুরু করে বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেরল নেতৃত্ব বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে। অনেক বাম বিশ্লেষকের মতে, এই লবির অভ্যন্তরীণ হিংসা এবং আঞ্চলিক সংকীর্ণতা পশ্চিমবঙ্গকে ও বাঙালিদের জাতীয় নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। 

সূত্রের দাবি, ১৯৯৬ সালের বৈঠকে কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশের নেতারা বসুর নামের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হন। তাঁদের যুক্তি ছিল, “ক্ষমতার স্বাদ নিলে পার্টি নীতিহীন হয়ে পড়বে”—একটি আদর্শিক মোড়কে আচ্ছাদিত বাস্তবিক আঞ্চলিক জেলাসূত্র। অথচ ঐ সময় দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এমন একজন অভিজ্ঞ ও সম্মানিত নেতার প্রয়োজন ছিল যিনি কংগ্রেস ও বামপন্থী শক্তিগুলিকে এক ছাতার নীচে আনতে পারতেন। প্রশ্ন উঠছে—ভারতবর্ষ কি একটি যোগ্য, অভিজ্ঞ বাঙালি প্রধানমন্ত্রীকে হারাল কেরল লবির সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে? যে সময় একটি জাতীয় সংহতি ও পরিণত নেতৃত্ব প্রয়োজন ছিল, সিপিএম তাদের ‘ব্লান্ডার-প্রুফ’ মনোভাব ও কেরল-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেই সুযোগ নষ্ট করে।