উদ্দালক
বিজ্ঞান আর মিথোলজির মধ্যে একটা তার আছে বলে মনে করেন অনেকে। সেই নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার শেষ নেই। তবে ভারতীয়রা বিজ্ঞানকে এক অন্য দৃষ্টিতে দেখেছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন। তাঁরা বলেন, বিজ্ঞানকে পাশ্চাত্য যেখানে দেখে কেবলমাত্র বাস্তব-ভিত্তিক যুক্তি পরম্পরার সিদ্ধান্ত হিসাবে সেখানে প্রাচ্য বিজ্ঞানকে দেখেছে হৃদয় দিয়ে। সেখানে হৃদয়কে দোলা দিয়েছে বিজ্ঞানের নানা নতুন রং। যাদবপুর মন্থন প্রযোজিত ‘রামানুজন’ নাটকটি প্রাচ্যের সেই চর্চার অন্তরকে ছুঁতে চাইল। ছুঁতে চাইল মননকে।
শ্রীনিবাস রামানুজন ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম। গোঁড়া হিন্দু পরিবারের গোঁড়ামির বেড়া ভেঙে তিনি পরাধীন ভারতে গিয়েছিলেন বিদেশে, পড়াশোনা করতে। মাত্র ৩২ বছর বয়সের মধ্যে তৎকালীন ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়া ভেঙে ফেলে তিনি বিজ্ঞানকে এনে বসিয়েছিলেন ভারতবাসীর সামনে। ২০১৬ সালে ম্যাথু ব্রাউন একটি ছবি তৈরি করেছিলেন, ‘দ্যা ম্যান ফু নিউ ইনফিনিটি’, সেই ছবিতে দেখানো হয়েছিল, কী অসাধারণ মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রামানুজনের জীবন জুড়ে। শুধু ভারতে নয়, যখন তিনি বিদেশে যাবেন, তখনও, একইভাবে জেএইচ হার্ডি আর জল লিটলউডের সঙ্গে গড়ে উঠবে তাঁর চিরকালীন সম্পর্ক, তেমনই স্ত্রী জানকীর সঙ্গেও তাঁর তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত এক সম্পর্ক। একজন গণিতবিদের জীবনের সঙ্গে কীভাবে এমন আশ্চর্য মায়া জড়িয়ে থাকতে পারে, তা এই নাটক দেখিয়েছে।

নাটকে রামানুজন চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবব্রত দাস। দেবব্রতকে দেখে মনে হয়েছে, জীবন দিয়ে সে যেন উপলব্ধি করেছে নাটকের বিষয়কে। আপাতভাবে গণিতের তীব্র গভীরতায় পৌঁছনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। যে স্তরে গণিত পৌঁছয় আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে, সেখানে ইমোশন বা আবেগ থাকে যুক্তির সমকক্ষ হয়ে। দেবব্রত গণিতের সেই দক্ষতায় না পৌঁছেও আবেগে পৌঁছে গিয়েছেন অনন্য কৌশলে। যা সাধুবাদ যোগ্য। বাংলা রঙ্গমঞ্চের দাপুটে অভিনেত্রীদের মধ্যে মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। তিনি অসামান্য অভিনয় করেছেন এই নাটকে। রামানুজনের মা কমলতাম্মালের ভূমিকায় তিনি আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করেছেন। কীভাবে সন্তানের প্রতি তাঁর স্বার্থপরতা-ভালবাসার সূক্ষ্ম সুতোয় তিনি যাতায়াত করছেন অনায়াসে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। নাটকে প্রফেসর হার্ডি ও লিটলউডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বাবসু বিশ্বাস। এরা আসলে এই গল্পের দুই সূত্রধর বলে চলে। তাঁরা রামানুজনকে নিয়ে চলেছেন তাঁর গোটা যাত্রা জুড়ে। আসলে শিক্ষা ও গবেষণার যে কাঁটাতারের বেড়া নেই, দেশে-দেশে শত্রুতা নেই, সে কথা প্রমাণ করে এই দু’টি চরিত্র। এরা নিঃসন্দেহে নিজেদের আবেগ ও ভূমিকার সচেতন গণ্ডি বজায় রেখেই অভিনয় করে গিয়েছেন। যে অভিনয় এরা করেছেন, তাতে এদের দু’টি ভিন্ন বৃত্ত তৈরি হয়েছে। সকলেই অত্যন্ত ভাল অভিনয় করেছেন, একটি সুরে অভিনয় করেছেন। তবে প্রত্যেকের কথা বলতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে পড়বে। এসবের বাইরেও সামান্য সংলাপ বা না-সংলাপ নিয়েও দীর্ঘক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত থেকে অবাক করে দিয়েছেন দেবী নমোগিরির ভূমিকায় ঐশিকী ঘটক আর জানকীর ভূমিকায় জিশা পয়রা। এদের অভিনয় ও মঞ্চ উপস্থিতির কিছু কিছু অংশ বারবার দেখার মতো, শেখার মতো।
দিশারী চক্রবর্তী বাংলা থিয়েটারের আবহ ও সঙ্গীত নির্মাণের অন্যতম পুরোধা। বর্তমানে তাঁর প্রতিটি কাজই স্বাদে, শ্রবণে আলাদা ও আকর্ষণীয়। এই নাটকের সঙ্গীত নির্মাণ করেছেন দিশারী, অসামান্য দক্ষতায়। রূপসজ্জা করেছেন সঞ্জয় পল, তিনিও স্বনামধন্য। দেবী নমোগিরির অবিশ্বাস্য নির্মাণ, পাশাপাশি, তৎকালীন তামিল হিন্দু পরিবারকে দেখে কোথাও অস্বস্তি হয়নি, বরং বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। নাটকের আলোক পরিকল্পনা করেছেন সৌমেন চক্রবর্তী। নাটকের পটভূমিকা যেহেতু মাঝে-মাঝেই পাল্টে যায়, পাল্টে যায় সময় সারণী, তাই আলোতেও সেই বিবর্তনকে ধরা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। সৌমেন সেই কাজ করেছেন অনায়াসে। এই নাটকের মুখোশ ও দৃশ্যপট নির্মাণ করেছেন অদ্রীশ কুমার রায়। তাঁর কাজও সাধুবাদ যোগ্য।
যে কোনও জীবন ভিত্তিক নাটকের নানারকম সমস্যা থাকে। বিখ্যাত কোনও মানুষের জীবনকে এক-এক জন জীবনীকার, এক-এর রকম করে দেখেন, লেখেন। ফলে ইতিহাস সেভাবেই তৈরি হয়। কখনও-কখনও তথ্য বিপরীত হয়, কখনও কখনও দ্বন্দ্ব থাকে। রামানুজনের ঈশ্বরভক্তি ও হিন্দু পরিচয়ের উদযাপন ছিলই, কিন্তু কতটা ছিল, তা নিয়ে নানারকম মতামত আছে। সেই বিতর্কের মধ্যে থেকে এক-এক জন এক-এক রকম ভাবে দেখতে চায় তাঁর জীবনকে। যাদবপুর মন্থনের বিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া এই নাটক হয়ত এভাবেই দেখতে চেয়েছে ভারতের গণিত বিষ্ময়কে। আর বিশ্বাস আছে বলেই জন্ম হয়েছে এক অসামান্য প্রযোজনার।
