সৌরভ গোস্বামী: বিশ্ব রাজনীতিতে আজ অদ্ভুত এক সময়। নৈতিকতা ও ক্ষমতার সীমানা এমনভাবে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে যে, কে নায়ক আর কে খলনায়ক—তা বোঝা কঠিন। বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুস, পাকিস্তানের মাওলানা মুনির আহমদ এবং আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প—তিনটি নাম, তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট, অথচ এক অভিন্ন সত্যের প্রতীক হয়ে উঠছে: রাজনৈতিক মতাদর্শের সংকট এবং নৈতিক ভাষার দখলদারি।
বাংলাদেশে ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে মামলাটি শুধুই শ্রম আইন বা প্রশাসনিক ব্যত্যয়ের প্রশ্ন নয়। এটি আসলে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সম্পর্কের এক গভীর দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছে। যে রাষ্ট্র “উন্নয়ন”কে ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, সেই রাষ্ট্রের সামনে একজন “মানবিক অর্থনীতির” প্রতীক কতটা স্বাধীন?
ইউনুসের ভাবমূর্তি পশ্চিমী পরিমণ্ডলে “উন্নয়ন–মানবতা”র এক মুখোশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁর দেশেই তাঁকে প্রতিহত করা হচ্ছে—এই বৈপরীত্য কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নয়, বরং অর্থনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত। রাষ্ট্রনির্ভর পুঁজিবাদ বনাম এনজিওভিত্তিক পুঁজিবাদ—দুই ক্ষেত্রেই জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ অনুপস্থিত।
পাকিস্তানের মাওলানা মুনির আহমদ আজ “ধর্মীয় ঐক্য”র ভাষায় এক নতুন রাজনৈতিক প্রকল্প দাঁড় করাতে চাইছেন। তাঁর বক্তৃতায় ইসলামের নৈতিকতা যেমন আছে, তেমনি পশ্চিম-বিরোধী ক্ষোভও জড়ানো। এই ভাষা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও এমনকি বাংলাদেশেও নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে—কারণ এটি “অসন্তুষ্টির রাজনীতি”-কে নৈতিকতার ছায়ায় ঢেকে দেয়।
ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও রাজনীতিতে ধর্মের অতিমাত্রিক ব্যবহার শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পরাধীনতাকেই পুনরুজ্জীবিত করে। মুনির আহমদের আহ্বান তাই কোনো মুক্তির পথ নয়, বরং এক নতুন মতাদর্শিক বন্দিত্বের সূচনা—যেখানে বিশ্বাস ও ক্ষমতা একে অপরকে ব্যবহার করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন কেবল মার্কিন রাজনীতির ঘটনা নয়, এটি এক আন্তর্জাতিক প্রবণতা। যে ডানপন্থা একসময় প্রান্তিক ছিল, তা আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে। জাতীয়তাবাদ, অভিবাসনবিরোধিতা, আর “নিজেদের আগে”র স্লোগান—সবই অর্থনৈতিক অসন্তোষকে এক প্রতিশোধপরায়ণ পুঁজিবাদে রূপান্তরিত করছে। ট্রাম্পের রাজনীতি কেবল আমেরিকার নয়; ভারত, ইজরায়েল, ইউরোপ—সব জায়গায় তার ছায়া পড়ছে। এ যেন পুঁজির নতুন মুখ, যেখানে শোষণের যুক্তি হলো “দেশপ্রেম”।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই তিন প্রবাহ একে অপরের সঙ্গে মিশে এক জটিল বাস্তবতা তৈরি করছে। একদিকে এনজিও-ধর্মী মানবিক পুঁজিবাদ (ইউনুস মডেল), অন্যদিকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (মুনির মডেল), এবং তার উপর আন্তর্জাতিক ডানপন্থার পুনরুত্থান (ট্রাম্প মডেল)।
ফল—মানুষের প্রশ্ন ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, স্থান নিচ্ছে প্রতীকের রাজনীতি। যেখানে “মানবতা”, “ধর্ম” ও “দেশপ্রেম”–এই তিনটি শব্দ এখন বাজারজাত পণ্য। রাজনীতি আর সমাজের সেবায় নেই; সমাজই এখন রাজনীতির কাঁচামাল।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই মুসলিম রাষ্ট্র—পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—বর্তমানে এমন এক মতাদর্শগত অক্ষ গঠনের পথে, যা ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক উদ্বেগের কারণ হতে পারে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ধর্মীয় পুনর্জাগরণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন—বিশেষ করে ইসলামাবাদ, পেশোয়ার ও করাচি অঞ্চলে মাওলানা মুনির আহমদ–এর নেতৃত্বে ইসলামি গোষ্ঠীগুলির রাজনৈতিক সক্রিয়তা বেড়ে ওঠা। বিশেষত বাংলাদেশ-ভারত লাগোয়া অঞ্চলে ঘোরাফেরা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ ভারতের কাছে।
এই প্রবণতা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং “কৌশলগত ও পরিকল্পিত”. পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানসমূহ (বিশেষত আইএসআই) ধর্মীয় নেতৃত্বকে ব্যবহার করছে একটি “মৌলবাদী ভূ-কৌশলগত চক্র” তৈরি করতে—যার লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত চাপ সৃষ্টি করা, এবং কাশ্মীর প্রশ্নকে ইসলামি ঐক্যের আবেগের সঙ্গে যুক্ত করে পুনরায় উত্তপ্ত করা।
ভারতের সতর্ক থাকতে হবে যে, পাকিস্তান এখন তার পুরনো নীতির পুনরাবৃত্তি করছে—কিন্তু এবার তা শুধু সামরিক নয়, বরং সমাজমুখী ধর্মীয় আবহে। এই ধর্মীয় রাজনীতির বিস্তার ভারতের পূর্ব ও উত্তর সীমান্তে “অদৃশ্য মতাদর্শগত অবরোধ” তৈরি করছে। মুহাম্মদ ইউনুস–এর আমলে বাংলাদেশের ভেতরে বর্তমানে এক নরম ক্ষমতা–সংকট (soft power crisis) তৈরি হয়েছে। এই বিষয় পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাতে শেখ হাসিনা সতর্ক করেছেন।
তিনি মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও এনজিও–কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মডেল এখন দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে ধরা পড়েছে—
একদিকে সরকারের রাষ্ট্রনির্ভর কর্তৃত্ববাদ, অন্যদিকে পশ্চিম-সমর্থিত ‘মানবিক পুঁজিবাদ’। হাসিনা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে বিদেশি শক্তিগুলি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। অতএব ইটা বলাই যায়, যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক মতাদর্শের বিভাজন তৈরি হয়, সে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর স্বাধীন থাকে না।
আরও উদ্বেগজনকবিষয় হল বাংলাদেশের কিছু ইসলামি সংগঠন সম্প্রতি পাকিস্তান ও তুরস্কের ধর্মীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে,
যা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে এক নতুন মতাদর্শগত চেইন তৈরি করছে। এই ঢাকা–ইসলামাবাদ–আঙ্কারা সংযোগ একধরণের “অদৃশ্য ত্রিভুজ” বলে অভিহিত করেছেন, যার রাজনৈতিক প্রভাব শুধু ধর্মীয় নয়, কৌশলগতও। ভারত এই ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনকে প্রথমে কেবল সীমান্ত–নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে, কিন্তু আদর্শগত দিকটি উপেক্ষা করেছে।
পাকিস্তান–বাংলাদেশ–তুরস্ক অক্ষ এখন এক ধরনের প্রতীকী ঐক্যের রাজনীতি চালাচ্ছে, যার লক্ষ্য ভারতকে আন্তর্জাতিক পরিসরে মুসলিম দুনিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা। এটি সামরিক হুমকি নয়, বরং “ভূ-রাজনৈতিক ধারণার যুদ্ধ” — এক নতুন ধরনের ''soft war''।
ভারত যদি এই মতাদর্শগত স্রোতকে রাজনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে প্রতিহত করতে না পারে,তাহলে দক্ষিণ এশিয়া আগামী দশকে ধর্মীয় ব্লকের পুনর্গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। ভারতকে কেবল সামরিক নয়, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক পরিসরেও পুনর্গঠন করতে হবে—
বিশেষত বাংলা ও পাঞ্জাব অঞ্চলকে 'সেতু' হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মানবতাবাদী যোগাযোগের পরিসর বাড়াতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ভেতরে আদর্শগত পুনর্গঠন চলছে, এবং তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ডানপন্থার ছায়া। যদি ভারত এই প্রক্রিয়াকে কেবল সীমান্ত বা নিরাপত্তা প্রশ্ন হিসেবে দেখে, তাহলে একদিন এই মতাদর্শগত অক্ষ—“ইউনুস–মুনির–ট্রাম্প মডেল”—পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্র পুনরায় বদলে দেবে।
