গোপাল সাহা
অস্টিওপোরোসিস এমন একটি রোগ যা শুনলেই আতঙ্কের সৃষ্টি হয় প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে। কারণ এই রোগে পুরুষ বা নারী নির্বিশেষ ৩০-এর পর থেকেই আক্রান্ত হতে পরে। তবে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। আর এই রোগে আক্রান্ত হলে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ যেমন বিপাকে পড়ে পাশাপাশি একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেই রোগীকে। অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থভাবে চলাচল করতে পারেন না। জীবনে একাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয় এই ধরনের রোগীদের। চিকিৎসার কারণে ওষুধের একটা ভার বহন করতেই হয় সারা জীবন, একই সঙ্গে অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে নানাবিদ সমস্যা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এই রোগীদের। আর সেই সমস্যাকে সমূলে উৎপাটনের চিন্তা নিয়েই চিকিৎসকরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে তৈরি করেছেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউম্যাটোলজি।
অস্টিওপোরোসিস দুই প্রকারের। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি। প্রাইমারি অস্টিওপোরোসিস বয়স কালে হয় মহিলা এবং পুরুষদের উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে। প্রাইমারি ক্ষেত্রে ১০০ জনের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ আক্রান্ত হয়ে থাকেন বলে চিকিৎসকদের দাবি। মহিলাদের মধ্যেই প্রবণতা বেশি থাকে পুরুষদের কম। রোগের শনাক্তকরণও পুরুষদের অনেক কম হয়। ফলে পুরুষদের হাড় বা জয়েন্ট ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
আরও পড়ুন: শুধুই স্বাস্থ্য না অন্য কিছু? উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়ের ইস্তফার পরেই সামনে আসছে অনেক তত্ত্ব
সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস অন্য কোনও অসুখের কারণেও হতে পারে। এটি মূলত অল্প বয়সী ছেলে অথবা মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় এবং কোমরভিডিটির কারণে অর্থাৎ লিভারের সমস্যা থেকে কিডনির সমস্যা থেকে কিংবা বহুদিন ধরে স্টেরয়েড ট্রিটমেন্ট চলছে, ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে অস্টিওপোসিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেহেতু এটি নিঃশব্দে হামলা চালায় তাই আক্রান্তের প্রবণতা এবং গভীরতা অনেক বেশি হয়ে যায়।
এই ধরনের রোগে নিঃশব্দে আক্রান্ত হওয়ার কারণে কোমরবিডিটি অনেক বেশি জোরালো থাকে এবং যার কারণে কোমরে ফ্র্যাকচার বা মেরুদন্ড ভেঙে গেলে অপারেশন হওয়ার পরে রিক্স ফ্যাক্টর বা মৃত্যুর সম্ভাবনা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ভয়ের কারণ থেকে যায়। আর সেই বিষয়টিকেই নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউম্যাটোলজি।
চিকিৎসক মতে ‘অস্টিওপোরোসিস’নিঃশব্দ ঘাতক হওয়ায় সঠিক সময়ে নির্ণয় না হলে ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। অস্টিওপোরোসিস আগাম কোনও সতর্ক বার্তা দেয় না। যখন বড়সড় কোনও অঘটন ঘটে তখন মানুষ জানতে পারেন। হাড় ফ্র্যাকচার হলে রোগী বুঝতে পারেন যে তিনি অস্টিওপোরোসিস’–এর শিকার। হাড় ক্ষয়ে এতটাই জীর্ণ হয়ে যায় তখন বিশেষ কিছু করার থাকে না।
অস্টিওপোরোসিসকে কেন নিঃশব্দ ঘাতক বলা হচ্ছে, সময় থাকতে কি করণীয়, কিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব, শরীরের বিভিন্ন অংশে কীভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে অস্টিওপোরোসিস?—এই সমস্ত বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন চিকিৎসকরা। কারেন্ট ট্রিটমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস ফর অপটিমাইজিং বোন হেলথ, ওবেসিটি অ্যান্ড বোন হেলথ, অস্টিওপোরোসিস ফ্র্যাকচারস অ্যান্ড অর্থোপেডিক পয়েন্ট অফ ভিউ, বোন হেলথ ইন ডায়াবেটিস, প্রি–মেনোপজাল অস্টিওপোরোসিস সহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এশিয়ান ইনস্টিটিউটের (AIIR) আয়োজিত অনুষ্ঠানে গভীর আলোচনা হয়।
যেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বনামধন্য রিউম্যাটোলজিস্ট-সহ মেডিসিন, এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞরাও। এ ছাড়াও বেঙ্গালুরু, নয়ডা, সিএমসি ভেলোর, এবং ইংল্যান্ড থেকেও অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা হাড়ের স্বাস্থ্যরক্ষা, অস্টিওপোরোসিস নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। প্রখ্যাত চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সুকুমার মুখার্জি, রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞ ডাঃ অলোকেন্দু ঘোষ, ডাঃ প্রদ্যুৎ সিনহামহাপাত্র, ডাঃ অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ পার্থজিৎ দাস, এন্ডোক্রিনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম বিশেষজ্ঞ ডাঃ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ ডাঃ শুভঙ্কর চৌধুরী, ডাঃ সুজয় ঘোষ-সহ ১৫০ জনের মতো প্রতিনিধি অংশ নেন এই অনুষ্ঠানে।

আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউম্যাটোলজি (AIIR) এর ডিরেক্টর চিকিৎসক পার্থজিৎ দাস বলেন, “বয়সের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষেরই হাড় ক্ষয়ে যায়। মহিলাদের মধ্যে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ থাকে। মেনোপজের পর বিশেষ কিছু হরমোন ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায় যে কারণে হাড়ের ক্ষয় বেশি হয়। তার প্রভাব বুঝতে পারে প্রথমবার যখন ফ্র্যাকচার হয়। বয়স্ক মানুষ সামান্য পড়ে গেলেই হাত, পা, কোমর, পেলভিস ভেঙে যাচ্ছে, এইভাবে বহু মানুষ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। অস্ত্রোপচার, অস্ত্রোপচারের পরবর্তী সময়ে কোনও সমস্যা হলে তার খরচ সামলাতে গিয়ে পরিবারের নাজেহাল হতে হয়। সামাজিক–আর্থিক–মানসিক সবদিকেই প্রভাব পড়ে। এই বিষয়টিকে আমরা প্রতিরোধ করতে চাই। মানুষ সচেতন হলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।”

চিকিৎসক অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সচেতনতা নেই বলেই প্রথমবার অস্টিওপোরোসিস অসুখটা ধরা পড়ছে কোনও কোনও ফ্র্যাকচারের মাধ্যমে। ফ্র্যাকচার হওয়াটাকে প্রতিরোধ করতে আমরা দ্রুত রোগ নির্ণয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। এখনকার দিনে হাড়ের ক্ষয় আটকানোর অনেক ভাল ভাল থেরাপি বিভিন্ন ধরণের ওষুধ বেরিয়েছে। ফ্যাকচার হওয়ার আগেই রোগটা ধরা পড়লে খরচও অনেক কমানো সম্ভব। মেনোপজের পর মহিলাদের অবশ্যই ‘বোন ডেনসিটি টেস্ট’(ডেক্সা স্ক্যান)করিয়ে নেওয়া জরুরি। অন্তত ২ বছর অন্তর এই টেস্ট করানো দরকার। বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কারও মেনোপজ হলে, কারও ৪০ বছরেই মেনোপজ হলে, পরিবারে ফ্র্যাকচারের ইতিহাস থাকলে তাদের আরও বেশি করে সচেতন হতে হবে। স্ক্রিনিং করে ধরা পড়লে প্রতিরোধ সম্ভব। আগাম কোনও উপসর্গ নেই বলেই আমরা সাইলেন্ট কিলার বলছি’’
AIIR-এর অ্যাকাডেমিক অ্যাডভাইসর কনসালট্যান্ট রিউম্যাটোলজিস্ট ডাঃ প্রদ্যুৎ সিনহা মহাপাত্র বলেন, “শুধু মেনোপজই নয়, অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। ক্রনিক ডিজিজে কেউ ভুগলে যেমন অটোইমিউন ডিজিজ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, কোনও কারণে স্টেরয়েড দীর্ঘদিন ধরে খেলে, ক্যান্সারের কেমোথেরাপি চললে, ক্রনিক কিডনির অসুখ থাকলে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই সমস্ত কারণে দ্রুত রোগ চিহ্নিত করে ফ্র্যাকচার হওয়া প্রতিরোধ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। বিশেষ পরিস্থিতিতে কি করা সম্ভব, কোন ওষুধ খাবে সেগুলি নিয়ে আলোচনা, সচেতনতা বাড়ানোই মূল লক্ষ্য।”
