আধুনিক চিকিৎসা, উন্নত ওষুধ আর ইনসুলিন থেরাপির অনেক আগেই মানুষ রোগমুক্তির ভরসা খুঁজত বিশ্বাসে আর আচার-অনুষ্ঠানে। মন্দির-ই হয়ে উঠত আশ্রয়স্থল। কেউ প্রার্থনা করত পক্ষাঘাত সারানোর জন্য, কেউ সন্তানলাভের আশীর্বাদ চাইত, কেউ বা অনির্দিষ্ট রোগ থেকে রক্ষার আশায় মাথা ঠুকত শিবলিঙ্গে। এই বিশ্বাসগুলো হয়তো চিকিৎসাবিজ্ঞানের নির্দিষ্ট সমাধান দিতে পারে না, কিন্তু মানসিক শক্তি, স্বান্ত্বনা আর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহসও হয়তো অনেককে দিয়েছে।

 

ভারতে এইমুহূর্তে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির একটি ডায়াবেটিস, লোকমুখে যাকে বলা হয় ‘সুগার’। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসকে অনেকে বলে 'সাইলেন্ট কিলার'। শরীর ঠিকমতো ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে বা ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজে না লাগলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকলে ডায়াবেটিস মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে চোখ, কিডনি, স্নায়ু ও হৃদ্‌যন্ত্রের। বেশিরভাগ রোগীকেই প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়, নিয়মিত রক্তপরীক্ষা এবং অনেক ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও একে সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলার কথা বলে না।

 

এই বাস্তবতার মাঝেই বিশ্বাস নিজের জায়গা ধরে রেখেছে। তামিলনাড়ুর ভেন্নিতে অবস্থিত করুম্বেশ্বরর মন্দির তার এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। হাজার বছরের পুরনো এই শিবমন্দিরে মহাদেব পূজিত হন ‘করুম্বেশ্বরর’ নামে অর্থাৎ ‘আখের ঈশ্বর’। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্দিরে প্রার্থনা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসে, এমনকী অনেকের ক্ষেত্রে উপশমও ঘটে! এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটি আলাদা। এখানে শিবলিঙ্গ সাজানো হয় আখ দিয়ে। অভিষেক হয় দুধ, দই, মধুর পাশাপাশি আখের রস দিয়েও। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির আশায়।

 

 

 

দশকের পর দশক ধরে এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে নানা অভিজ্ঞতার গল্প। কেউ বলেন, মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা কমেছে। কেউ দাবি করেন, চিকিৎসক ওষুধের ডোজ কমিয়ে দিয়েছেন। এই বিশ্বাসই মন্দিরটিকে পরিণত করেছে ‘দিব্য আরোগ্যের’ আশ্রয়স্থলে।

 

এখানকার মন্দিরের নৈবদ্যও ভীষণ অর্থবহ। যেখানে ডায়াবেটিস রোগীদের মিষ্টি সম্পূর্ণ বারণ, সেখানেই ভক্তেরা শিবের কাছে চিনি আর মিষ্টি ভাত নিবেদন করেন। অনেকের মতে, এ এক প্রতীকী আত্মসমর্পণ। নিজের লোভ, অভ্যাস আর অসুখটাকেই ঈশ্বরের হাতে তুলে দেওয়া, এই বিশ্বাসে যে মহাদেবই তাঁকে মুক্তির পথ দেখাবেন।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞান আর বিশ্বাস, দুটি পথ হয়তো সমান্তরাল। কিন্তু এই মন্দির প্রমাণ করে, অসুখের সঙ্গে লড়াইয়ে আশা আর আস্থাও অনেকের কাছে এক শক্তিশালী ওষুধ। তবে এই বিশ্বাসে সবাই যে আস্থা রাখেন, তা নয়। অনেকেরই মতে, জীবনযাপনে পরিবর্তন, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা আর ওষুধ না মেনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। তাঁদের স্পষ্ট যুক্তি, কোনও আচার বা রীতিই ইনসুলিন বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের জায়গা নিতে পারে না। বিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক, রোগ সামলাতে গেলে চিকিৎসাই শেষ কথা। তবু এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মধ্যে কোনও সংঘাত দেখেন না। তাঁদের কাছে পথটা মাঝামাঝি। পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি মানসিক শক্তির জন্য আধ্যাত্মিক শান্তি খোঁজা। এই সমন্বয়েই তাঁরা খুঁজে পান লড়াইয়ের সাহস।

 

এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই ভেন্নির করুম্বেশ্বরর মন্দির আজও হয়ে রয়েছে আশার প্রতীক। যেখানে বিশ্বাস অন্ধতা নয়, বরং ভরসা; আর চিকিৎসা উপেক্ষা নয়, বরং দায়িত্ব। ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, এই মন্দির যেন মনে করিয়ে দেয়, আস্থা আর বিজ্ঞান একে অপরের বিরোধী নয়, বরং বহু মানুষের জীবনে সহযাত্রী।