মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। যার মধ্যে দুটি সাধারণ সমস্যা হল পিসিওএস আর পিসিওডি। নামের মিলের কারণে এই দুই সমস্যাকে অনেক সময় একই রোগ বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ঠিক কী এই দুই রোগ? কীভাবে পার্থক্য বুঝবেন? সেবিষয়ে বিস্তারিত জানালেন আভা সার্জি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ কনসালটেন্ট ড. বাণী কুমার মিত্র।
পিসিওএস কী? এটি আসলে একটি জটিল মেটাবলিক ও হরমোনজনিত সমস্যা, যা প্রজনন বয়সি মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়। এই রোগে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, শরীরে অতিরিক্ত লোম, ব্রণ, ওজন বেড়ে যাওয়া এমনকী বন্ধ্যাত্বের সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে। পিসিওএস-এ ডিম্বাশয় অস্বাভাবিক পরিমাণে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন তৈরি করে। এর ফলে শুধু ঋতুস্রাব চক্রই নয়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আর হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ে।
অন্যদিকে পিসিওডি হলে ডিম্বাশয়ে ছোট ছোট একাধিক সিস্ট তৈরি হয়, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। পিসিওডি-তে অনিয়মিত ঋতুস্রাব আর ওজন বৃদ্ধির মতো উপসর্গ দেখা যায়। এটি তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে অবহেলা করলে এটিও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে।

পিসিওএস ও পিসিওএস-এর কেন বিভ্রান্তি হয়? অনেক মহিলা ঋতুস্রাবের অনিয়ম, ওজনের ওঠানামা বা ব্রণকে সাধারণ সমস্যা মনে করেন। যার জন্য চিকিৎসায় অবহেলা করে যান। এর ফলে রোগ ধরা পড়তে দেরি হয়। বিশেষ করে পিসিওএস চিকিৎসাহীন অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য, ডায়াবেটিস আর মেটাবলিক সিনড্রোমের মতো বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
পিসিওএস আর পিসিওডি দুটি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতেই প্রথমে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চা, ফাইবারসমৃদ্ধ ও কম চিনি যুক্ত খাবার খাওয়া, স্ট্রেস কমানো আর পর্যাপ্ত ঘুমও প্রয়োজন। পিসিওএস রোগীদের ক্ষেত্রে হরমোন নিয়ন্ত্রণে আনতে ওষুধের প্রয়োজন হয়। পিসিওডি অনেকাংশে স্বাস্থ্যকর অভ্যাসেই নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে সেপ্টেম্বর মাসকে 'পিসিওএস সচেতনতা মাস' হিসেবে পালন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, অতিরিক্ত লোম, হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা দীর্ঘস্থায়ী ব্রণকে অবহেলা করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে দ্রুত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন মহিলা পিসিওএস-এ ভোগেন। ভারতে এই হার ১০–২০% এর মধ্যে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ে না সচেতনতার অভাবে। গবেষণা অনুযায়ী, পিসিওএস আক্রান্ত মহিলাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিতে ২–৩ গুণ বেশি থাকে। প্রায় ৭০% রোগীর প্রজনন ক্ষমতা প্রভাব পড়ে। তবে সুখবর হল, নিয়মিত চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ৭০–৮০% মহিলা লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
শুধু শারীরিক নয়, পিসিওএস ও পিসিওডি মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। ব্রণ, অতিরিক্ত ওজন বা বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা মহিলাদের হতাশায় ফেলে দেয়। তাই পরিবার ও সমাজে খোলামেলা আলোচনা, সহায়তা আর সচেতনতা গড়ে তোলাই সবচেয়ে জরুরি। একথা ঠিক যে পিসিওএস ও পিসিওডি আলাদা রোগ। তবে দুটোই প্রজনন স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা, সচেতনতা এবং জীবনধারায় পরিবর্তন আনলেই এই সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
