মূত্র কেবলমাত্র কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে বার হওয়া অতিরিক্ত জল বা বর্জ্য নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জানালা হিসাবেও কাজ করে। চিকিৎসকেরা প্রায়ই মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু কিডনি নয়, লিভার, ব্লাডার এমনকি মেটাবলিক সিস্টেমের সমস্যাও শনাক্ত করেন। মূত্রের রঙ, ঘনত্ব বা গন্ধের সূক্ষ্ম পরিবর্তনও লুকিয়ে থাকা অসুস্থতার প্রাথমিক সতর্ক সংকেত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শরীর মূত্রের মাধ্যমে সমস্যার সঙ্কেত দেয় অন্য উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার অনেক আগেই। সংক্রমণ, লিভারের অসুখ, কিডনির সমস্যা কিংবা কিছু ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণও মূত্রের অস্বাভাবিকতার মাধ্যমেই ধরা পড়তে পারে। মূত্রের মাধ্যমে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত এবং এমন কিছু লক্ষণের কথা বলা হল, যেগুলো কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়।
মূত্রে রক্ত (হিমেচুরিয়া)
মূত্রে লাল বা গোলাপি আভা দেখা উদ্বেগজনক এবং সঙ্গত কারণেই তা চিন্তার বিষয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে হিমেচুরিয়া বলা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI), কিডনি বা ব্লাডারের পাথর এবং গুরুতর ক্ষেত্রে কিডনি বা ব্লাডারের ক্যানসার। বিটরুটের মতো কিছু খাবার বা কিছু ওষুধ মূত্রকে সাময়িকভাবে লালচে রঙ দিলেও, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে লাল মূত্র দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
এমন অবস্থায় প্রায়ই প্রস্রাবের সময় ব্যথা, জ্বালাভাব, বারবার প্রস্রাব পাওয়া বা কোমরের নিচে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এসব উপসর্গ উপেক্ষা করলে গুরুতর অসুখ ধরা পড়তে দেরি হতে পারে। সাধারণত মূত্র পরীক্ষা, ইমেজিং স্ক্যান বা সিস্টোস্কোপির মাধ্যমে কারণ নির্ণয় করা হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গাঢ় বাদামি বা কোলার রঙের মূত্র
অস্বাভাবিকভাবে গাঢ় বাদামি বা চায়ের মতো রঙের মূত্র প্রায়ই লিভার, কিডনি বা পেশির গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, হেপাটাইটিস বা সিরোসিসের মতো লিভারের অসুখে শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা মূত্রকে গাঢ় করে তোলে। তেমনি গুরুতর কিডনি রোগে বর্জ্য জমা হয় এবং পর্যাপ্ত জল খেলেও মূত্র গাঢ় রঙ ধারণ করে।
এছাড়াও র্যাবডোমায়োলাইসিস নামের এক সমস্যা থেকেও এটি হতে পারে। এই সময় পেশি ভেঙে গিয়ে রক্তে মায়োগ্লোবিন ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে তা মূত্রে ছেঁকে বার হয়। চিকিৎসা না করলে এটি কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদি গাঢ় মূত্রের সঙ্গে জন্ডিস, ত্বক বা চোখ হলদে হওয়া, অবসাদ বা পেটব্যথা দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মূত্রের অস্বাভাবিক গন্ধ
সাময়িকভাবে মূত্রের গন্ধ পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, যেমন শরীরে জলের অভাব, কিছু খাবার বা ওষুধের কারণে। তবে যদি মূত্রে কয়েক দিন ধরে তীব্র বা অস্বাভাবিক গন্ধ থাকে, তা শরীরের অসুখের ইঙ্গিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মূত্রনালীর সংক্রমণ মূত্রে তীব্র অ্যামোনিয়ার মতো গন্ধ তৈরি করে। কিছু সংক্রমণে আবার মূত্রে মিষ্টি বা একেবারেই অস্বাভাবিক দুর্গন্ধও আসতে পারে।
কিছু বিরল বংশগত মেটাবলিক রোগ, যেমন ফেনাইলকিটোনুরিয়া বা ম্যাপল সিরাপ ইউরিন ডিজিজ-এ শরীর নির্দিষ্ট কিছু পদার্থ ভাঙতে পারে না, ফলে মূত্রে খুব তীব্র গন্ধ হয়। আবার লিভারের অসুখ হলে শরীরে টক্সিন জমে যায়, যা মূত্রের গন্ধ বদলে দেয়। যদি তীব্র গন্ধের সঙ্গে জ্বর, মূত্রের রঙ পরিবর্তন, ব্যথা বা বিভ্রান্তি দেখা দেয়, তবে তা সংক্রমণ বা মেটাবলিক সমস্যার সঙ্কেত হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঘোলা বা অতিরিক্ত ফেনাযুক্ত মূত্র
মূত্র ঘোলা হলে প্রায়শই এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, শ্বেত রক্তকণিকা বা স্ফটিক থাকে, যা সাধারণত মূত্রনালী বা কিডনির সংক্রমণের লক্ষণ। এসব সংক্রমণ মূত্রকে দুর্গন্ধযুক্ত বা স্বাভাবিকের তুলনায় ঘন দেখাতে পারে।
অন্য দিকে, মূত্রে বারবার অতিরিক্ত ফেনা বা বাবল দেখা দিলে সেটি প্রোটিনুরিয়ার লক্ষণ হতে পারে, অর্থাৎ মূত্রে অতিরিক্ত প্রোটিনের উপস্থিতি। এটি কিডনির সমস্যার অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ। সুস্থ কিডনি রক্তের প্রোটিন ধরে রাখে, কিন্তু কিডনির ক্ষতি হলে প্রোটিন মূত্রে চলে আসে। যদি ফেনাযুক্ত মূত্রের সঙ্গে হাত, পা বা চোখের চারপাশে ফোলা দেখা দেয়, তবে কিডনির গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে এবং দ্রুত পরীক্ষা করানো জরুরি।
অস্বাভাবিক রঙ: সবুজ বা নীল মূত্র
কখনও কখনও মূত্র সবুজ বা নীল রঙ ধারণ করতে পারে। এর পিছনে থাকতে পারে কিছু ওষুধ যেমন অ্যামিট্রিপটাইলিন বা প্রপোফল। আবার অনেক সময় চিকিৎসায় ব্যবহৃত রঙিন ডাই বা খাবারের কৃত্রিম রঙ দায়ী হতে পারে। কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, যেমন সিউডোমানাস সংক্রমণও মূত্রকে সবুজ করে তুলতে পারে।
খাবারের কারণে সাময়িকভাবে রঙ পরিবর্তন ক্ষতিকর নয়, তবে যদি দীর্ঘদিন মূত্র সবুজ বা নীল থাকে, তবে তা সংক্রমণ বা লিভারজনিত সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। অনেক সময় এ ধরনের অস্বাভাবিক রঙ মূত্রনালীর সংক্রমণের প্রাথমিক সতর্ক সংকেত, যেটির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে। সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা অপরিহার্য।
