আজকাল ওয়েবডেস্ক: ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত লুভর জাদুঘরে রবিবার সকালে সংঘটিত এক চুরির ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ‘অমূল্য’ গয়না চুরি করে পালিয়েছে একদল মুখোশধারী দুষ্কৃতী। ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ঘটনাটি ঘটেছে দিনের আলোয়, যখন জাদুঘরটি সদ্য পর্যটকদের জন্য খুলেছিল। চুরির কারণে লুভরকে তাৎক্ষণিকভাবে খালি করা হয় এবং “বিশেষ কারণবশত” দিনভর বন্ধ রাখা হয়। ফলে হাজার হাজার পর্যটক, যারা মোনালিসা দেখতে এসেছিলেন, হতাশ হয়ে ফিরে যান।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লরঁ নিউনে জানিয়েছেন, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ডাকাতি সম্পন্ন হয়। চারজন দুষ্কৃতী মিলে পরিকল্পিতভাবে অভিযান চালায়। এদের মধ্যে দু’জন যান্ত্রিক মই ব্যবহার করে প্রথম তলার একটি জানালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের হুমকি দেয়। অপর দুইজন বাইরে থেকে সহযোগিতা করছিল বলে জানা গেছে। তারা ব্যাটারি চালিত কাটার দিয়ে কাঁচের প্রদর্শন বাক্স ভেঙে গয়নাগুলি তুলে নেয়। তারপর দ্রুত মোটরবাইকে চেপে পালিয়ে যায়।

জাদুঘরের যে অংশটি লক্ষ্য করা হয়েছিল, সেটি হলো ‘গ্যালারি দ্য আপোলন’ (Galerie d’Apollon), যেখানে ফ্রান্সের রাজকীয় অলংকার সংরক্ষিত রয়েছে। এই গ্যালারিতেই রয়েছে নেপোলিয়ন তৃতীয় এবং তাঁর স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির ব্যবহৃত গয়না। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোট নয়টি অলংকার চুরি হয়েছে, যার মধ্যে একটি—সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুট—চোরেরা পালানোর সময় ফেলে যায়। সেটি জাদুঘরের কাছেই পড়ে ছিল এবং পরে উদ্ধার করা হয়। তবে মুকুটটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রী রাশিদা দাতি জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলের কাছে পাওয়া মুকুটটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। জাদুঘরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এই মুকুটে ১,৩৫৪টি হীরক ও ৫৬টি পান্না বসানো রয়েছে। চুরি হওয়া অন্য গয়নাগুলির মধ্যে রয়েছে একটি পান্না জোড়া কানের দুল এবং একটি ব্রোচ, যা একসময় সম্রাজ্ঞী ইউজেনির প্রিয় ছিল।
ফরাসি পুলিশ জানিয়েছে, চোরেরা পালানোর আগে ব্যবহৃত যানটি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু জাদুঘরের এক কর্মীর উপস্থিত বুদ্ধিতে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সৌভাগ্যক্রমে ঘটনায় কেউ আহত হননি। বর্তমানে পুরো এলাকা ঘিরে তদন্ত চলছে এবং দুষ্কৃতীদের সন্ধানে তল্লাশি শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীরা সাধারণত এমন অলংকারই চুরি করে যা সহজে ভেঙে বিক্রি করা যায়, কারণ চুরি হওয়া শিল্পকর্ম বা চিত্রকর্মের মতো এগুলির বাজারে সনাক্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই গয়নাগুলিকে বর্ণনা করেছেন “অমূল্য” এবং “অপরিমেয় ঐতিহ্যবাহী সম্পদ” হিসেবে।
ঘটনার পর লুভরের প্রবেশদ্বারে বিশাল ভিড় জমে যায়। পুলিশ পর্যটকদের ফিরিয়ে দেয়। আমেরিকান পর্যটক জিম ও জোয়ান কার্পেন্টার জানান, তারা মোনালিসা দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের “জরুরি প্রস্থানপথে” নিয়ে যান। মিসেস কার্পেন্টার বলেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বড় ঘটনা ঘটছে।” এই চুরির ঘটনায় প্যারিসবাসী এবং বিশ্বজুড়ে শিল্পপ্রেমীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

তুলনামূলকভাবে দেখলে, লুভর জাদুঘরের এই বাস্তব ঘটনার সঙ্গে বলিউডের ধুম (Dhoom) চলচ্চিত্র সিরিজের কাহিনির মধ্যে চমকপ্রদ মিল রয়েছে। ধূম ছবিগুলিতে যেমন চোরেরা দিনের আলোয় বা শহরের কেন্দ্রস্থলে নজরকাড়া, প্রযুক্তিনির্ভর ডাকাতি চালিয়ে পুলিশকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যায়, লুভরের ঘটনাটিও অনেকটা তেমনই নাটকীয় এবং পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রথম ধুম (২০০৪)-এ জন (জন আব্রাহাম) মোটরবাইক গ্যাং নিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে দুঃসাহসী ডাকাতি চালায়। প্যারিসের এই চুরিতেও দেখা যায়, ডাকাতরা মোটরবাইক বা মপেড ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে পালিয়ে গেছে, যেমনটি সিনেমায় দেখা যায়—দ্রুতগামী যান, নিখুঁত সময়জ্ঞান, এবং পুলিশ আসার আগেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
ধুম ২ (২০০৬)-এর হৃতিক রোশন অভিনীত আরিয়ান চরিত্রের মতো এখানকার চোরেরাও নিখুঁত পরিকল্পনায় যান্ত্রিক উপায় ব্যবহার করেছে—যেমন একটি “ভেহিকল-মাউন্টেড এক্সটেন্ডেবল ল্যাডার” (যানবাহনে স্থাপিত প্রসারিত মই), যা ব্যবহার করে তারা প্রথম তলার জানালা দিয়ে প্রবেশ করেছে। হৃতিকের চরিত্র যেমন ঝুঁকি নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন বা মূল্যবান অলংকার চুরি করত, এখানেও চুরি হয়েছে ১৯শ শতকের ফরাসি রাজপরিবারের অমূল্য রত্ন।
আর ধুম ৩ (২০১৩)-এর কাহিনিতে যেমন চোরেরা নিজেদের শিল্প, কৌশল এবং নাটকীয়তায় মোড়া “বার্তা” রেখে যায়, তেমনি এই বাস্তব ঘটনাতেও আছে সাংস্কৃতিক প্রতীক—ফ্রান্সের ঐতিহ্য ও রাজকীয় ইতিহাসের “অমূল্য সম্পদ” হারিয়ে যাওয়া, যা দেশের আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে সিনেমা ও বাস্তবের পার্থক্যও স্পষ্ট। ধূম সিরিজে চুরি প্রায়ই নায়কোচিত, রোমাঞ্চকর ও বিনোদনমূলকভাবে উপস্থাপিত হয়; দর্শক সেখানে চোরদের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়। কিন্তু লুভরের ঘটনায় বাস্তব ক্ষতি হয়েছে—অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য অপরিমেয় ক্ষতি। সিনেমায় “স্টাইলাইজড থ্রিল” থাকলেও বাস্তবে রয়েছে আইনভঙ্গ, নিরাপত্তার দুর্বলতা এবং জাতীয় সম্পদ হারানোর বেদনা।
তবুও বলা যায়, লুভর চুরির এই ঘটনাটি যেন বাস্তব জীবনে ধুম ছবির এক দৃশ্যের প্রতিরূপ—যেখানে বুদ্ধি, প্রযুক্তি ও সাহস একসঙ্গে মিলিত হয়ে গড়ে তোলে এক দুঃসাহসী, কিন্তু গভীরভাবে উদ্বেগজনক অপরাধচিত্র।
