আজকাল ওয়েবডেস্ক: সিরিয়ার হোমস শহরের একটি প্রধানত আলাওয়ি অধ্যুষিত এলাকায় শুক্রবার জুমার নামাজের সময় একটি মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই ঘটনায় অন্তত আটজন নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়েছেন। ইসলামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক বছরে এটি কোনও উপাসনালয়ে দ্বিতীয় বড় হামলা।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানা (SANA) জানায়, হোমস শহরের ওয়াদি আল-দাহাব এলাকায় অবস্থিত ইমাম আলী বিন আবি তালিব মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরণটি ঘটে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে নিহতের সংখ্যা আট এবং আহতের সংখ্যা ১৮ বলে নিশ্চিত করেছে।
সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানায়, “শুক্রবারের নামাজ চলাকালীন একটি সন্ত্রাসী বিস্ফোরণের মাধ্যমে মসজিদটিকে লক্ষ্য করা হয়েছে।” বিস্ফোরণের পরপরই গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয় এবং ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
সানার উদ্ধৃত এক নিরাপত্তা সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে যে, মসজিদের ভেতরে আগে থেকেই পুঁতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইস থেকেই বিস্ফোরণটি ঘটে।
এলাকার এক বাসিন্দা, নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেন,“একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, তারপর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না, শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যাচ্ছে।”
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মসজিদের ভেতরের দেওয়ালে বড় একটি গর্ত তৈরি হয়েছে, চারপাশে কালো ধোঁয়ার চিহ্ন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কার্পেট ও ধর্মীয় বই।
হোমস শহরে সুন্নি মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও শহর ও আশপাশের এলাকায় একাধিক আলাওয়ি-অধ্যুষিত অঞ্চল রয়েছে। আলাওয়িরা মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখার অনুসারী। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নিজেও এই সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন।
২০২৪ সালে আসাদের পতনের পর থেকে হোমস প্রদেশে আলাওয়ি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস এবং স্থানীয় বাসিন্দারা।
গত মাসের শেষ দিকে, হোমসসহ বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর নতুন হামলার প্রতিবাদে আলাওয়ি উপকূলীয় অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে সিরিয়ার উপকূলীয় এলাকায় আলাওয়ি বেসামরিকদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, সাবেক আসাদপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
জাতীয় তদন্ত কমিশনের হিসাবে, ওই হিংসায় অন্তত ১,৪২৬ জন আলাওয়ি নিহত হন, তবে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস নিহতের সংখ্যা ১,৭০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছে।
অধিকার সংগঠন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের মিত্র গোষ্ঠীগুলি তিন দিনের হিংসায় গণহত্যা ও মাঠপর্যায়ের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধসহ পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে।
আলাওয়িদের পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জুলাই মাসে দক্ষিণ সিরিয়ার দ্রুজ-অধ্যুষিত সুয়াইদা প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে ৭৮৯ জন দ্রুজ বেসামরিক নাগরিককে প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সদস্যরা সংক্ষিপ্ত বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছেন বলে অবজারভেটরির দাবি।
এর আগে জুন মাসে দামাস্কাসের একটি গির্জায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫ জন নিহত হন। সিরীয় কর্তৃপক্ষ এই হামলার দায় ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ওপর চাপালেও একটি অল্পপরিচিত সুন্নি উগ্রবাদী গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছিল।
ডিসেম্বরে আসাদ পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা সব নাগরিকের ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে বলেন, “একটি শক্তিশালী সিরিয়া গড়তে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।”
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিরিয়ার অবস্থান পুনর্গঠনে কিছু অগ্রগতি হলেও, দেশের ভেতরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন কাটিয়ে ওঠা এখনো শারা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। নতুন এই বিস্ফোরণ সেই উদ্বেগকেই আরও গভীর করল।
