আজকাল ওয়েবডেস্ক: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (UNGA) ৮০তম অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পাকিস্তানকে নাম না নিয়েই তীব্র আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানই “গ্লোবাল টেররিজমের এপিসেন্টার” বা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। জাতিসংঘের স্যাংশন লিস্টে পাকিস্তানি নাগরিকদের উপস্থিতির কথাও তিনি তুলে ধরেন।

জয়শঙ্কর তাঁর বক্তৃতায় এপ্রিল মাসে জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্র পাহালগাঁও-এ  সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ তোলেন। ওই ঘটনায় ২২ এপ্রিল অন্তত ২৬ জন নিরীহ পর্যটক নিহত হন। প্রথমে লস্কর-ই-তোইবার ঘনিষ্ঠ সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট দায় স্বীকার করলেও পরে তারা দাবি প্রত্যাহার করে। এই ঘটনাকে পাকিস্তান-প্ররোচিত সীমান্তপারের সন্ত্রাসের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন জয়শঙ্কর।

তিনি জানান, “ভারত তার নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করেছে।” ওই ঘটনার পর ৭ মে থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনব্যাপী সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়, যেখানে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি ও পরিকাঠামোকে নিশানা করে।

আরও পড়ুন: দেশ কে চালায়, সেনা না সরকার? উত্তরে পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী যা বললেন, উত্তরে বিভ্রান্তি আরও বাড়ল

এর আগে জাতিসংঘের মঞ্চে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ দাবি করেন, সাম্প্রতিক সংঘর্ষে পাকিস্তান নাকি সাতটি ভারতীয় বিমান গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভারত ওই মন্তব্যকে “ড্রামা ও মিথ্যা” বলে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক ওই মন্তব্যকে “ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচার” আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ পোষণের দায় ঢাকতে প্রচারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ আনে।

জয়শঙ্কর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর কথায়, “টেরর ফাইন্যান্সিং রুখতে হবে,” “প্রধান জঙ্গি নেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে,” এবং “সম্পূর্ণ সন্ত্রাসবাদী ইকো-সিস্টেমের উপর অবিরাম চাপ বজায় রাখতে হবে।” তিনি সতর্ক করে দেন, যারা সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকদের প্রশ্রয় দেয়, শেষ পর্যন্ত তারাই এর শিকার হবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলমান সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতি ও সরবরাহ শৃঙ্খলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এমনকি যেসব দেশ সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িত নয়, তারাও জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের চাপ অনুভব করছে। জয়শঙ্কর বলেন, “যেসব দেশ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম, তাদেরই শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে। ভারত শত্রুতা বন্ধ ও শান্তি পুনঃস্থাপনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।”

জয়শঙ্কর বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আজ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে—“ট্যারিফ ভোলাটিলিটি” ও “মার্কেট অ্যাকসেসের অনিশ্চয়তা” বিশ্ব  অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলেছে। সরবরাহ শৃঙ্খল, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ ও প্রযুক্তি প্রবাহ এখন নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে এসেছে। সমুদ্রপথ রক্ষার বিষয়টিও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আজকের বিশ্বে ডি-রিস্কিং একটি প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠছে, আর তার সমাধান একটাই—অধিক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।”

জাতিসংঘের অকার্যকারিতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জয়শঙ্কর বলেন, সংঘাত, উন্নয়নের পশ্চাৎপদতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ইস্যুতে UN কার্যকর প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে বহুপাক্ষিকতার প্রতি আস্থা নষ্ট হয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় সদস্যপদ সম্প্রসারণের দাবি নতুন করে উত্থাপন করেন তিনি। বিশেষভাবে আফ্রিকার প্রতি “ঐতিহাসিক অবিচার” সংশোধনের উপর জোর দেন। ভারত যে বৃহত্তর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, তাও স্পষ্ট করে দেন।


জয়শঙ্কর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন হিসেবে তিনটি সূত্র তুলে ধরেন—

১. আত্মনির্ভরতা

২. আত্মরক্ষা 

৩. আত্মবিশ্বাস 


তিনি প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে জানান, ২০২৬ সালে ভারত বিশ্বব্যাপী একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্মেলনের আয়োজন করবে, যেখানে “অন্তর্ভুক্তি ও প্রভাব” হবে মূল নীতি। নিজের বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, “জাতিসংঘের নবম দশক হতে হবে নেতৃত্ব ও আশার দশক। ভারত তার ন্যায্য ভূমিকা পালন করবে, বরং প্রয়োজনে তার চেয়েও বেশি করবে।”