আজকাল ওয়েবডেস্ক: দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত দুই দিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিনেই বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলো একটি যৌথ ঘোষণা গ্রহণ করেছে। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ঘোষণায় চলমান আন্তর্জাতিক  সংঘাতগুলোর বিষয়ে তীব্র ভাষা পরিহার করা হয়েছে। সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বর্জন—যা জি-২০ গোষ্ঠী গঠনের পর থেকে এই প্রথম কোনো সদস্য দেশের পূর্ণ অনুপস্থিতি।

সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা প্লিনি দ্য এল্ডারের বিখ্যাত উক্তি “আউট অব আফ্রিকা, অলওয়েজ সামথিং নিউ” উদ্ধৃত করে ঘোষণা গ্রহণের জন্য হাত তোলার আহ্বান জানান। উপস্থিত সদস্যরা কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই ঘোষণা অনুমোদন করেন—অনুপস্থিত ছিল কেবল যুক্তরাষ্ট্র। রামাফোসা স্পষ্ট বার্তা দেন, জি-২০–এর প্রথম আফ্রিকান সভাপতিত্বের মর্যাদা যেন কোনো ঘটনা খর্ব না করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি—দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের “ হত্যা করা হচ্ছে”—এই ভুয়ো অভিযোগকে কেন্দ্র করেই ওয়াশিংটনের বর্জনের সিদ্ধান্ত। সম্মেলনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দেয়, আমেরিকান প্রতিনিধিত্ব না থাকলে ঐতিহ্যগতভাবে কোনো ঘোষণা গ্রহণ করা উচিত নয়। ওয়াশিংটনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “জি-২০ সর্বদা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ঘোষণা প্রকাশ করে এসেছে, আর দক্ষিণ আফ্রিকার এই পরিবর্তন লজ্জাজনক।”

পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা এই অবস্থানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “একজন আমন্ত্রিত দেশের অনুপস্থিতির কারণে গোটা বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়া থেমে যেতে পারে না।” একই বার্তা পুনর্ব্যক্ত করেন প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ভিনসেন্ট মাগুয়েনিয়া—“যে ভাষা যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি করেছে, তা পুনরায় আলোচনার সুযোগ নেই।”

এই বর্জনের ফলে জি-২০ সভাপতিত্ব হস্তান্তরের প্রথাগত প্রক্রিয়াও জটিল হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল স্থানীয় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের কাছে সভাপতি হস্তান্তর করা হোক, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা এটিকে প্রোটোকল লঙ্ঘন হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে পররাষ্ট্র মন্ত্রক  থেকে সভাপতিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রহ করতে হবে।

গত কয়েক বছরের মতো এবারও যৌথ ঘোষণা নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও—ইউক্রেন কিংবা গাজা প্রসঙ্গে কঠোর অবস্থানের বদলে—জোহানেসবার্গ ঘোষণায় এসেছে অত্যন্ত নরম ভাষা। এতে  অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ, অসমতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করা হলেও কোনও  নির্দিষ্ট সংঘাতের নাম উচ্চারণ করা হয়নি। কেবল এক জায়গায় টেকসই শান্তির প্রেক্ষাপটে সুদান, কঙ্গো, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন ও অন্যান্য সংঘাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে, ২০২৩ সালের নয়াদিল্লি ঘোষণায় ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাতটি অনুচ্ছেদ ছিল, আর ২০২৪ সালের রিওতে ছিল সংক্ষিপ্ত একটি অনুচ্ছেদ। এবছরের ঘোষণায় গাজার প্রসঙ্গে তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে—যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইসরায়েলবিরোধী আন্তর্জাতিক আদালত মামলার প্রেক্ষাপটে বিশেষ নজর কাড়ে।

এদিকে, ইউরোপীয় ও পশ্চিমা নেতারা সম্মেলনের সাইডলাইনে ট্রাম্প প্রস্তাবিত ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে আলাদা বৈঠক করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সতর্ক করেন যে, আন্তর্জাতিক  সংঘাত নিয়ে আলোচনা করতে ব্যর্থ হলে জি-২০–এর গুরুত্ব কমে আসতে পারে।

ভারত জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার, সন্ত্রাসবাদের নিন্দা, জলবায়ু-অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং ‘লাইফ’ (LiFE) উদ্যোগের মতো বেশ কিছু অগ্রাধিকার বিষয় ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ঘোষণায় ২০৩০ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর নির্ধারিত জলবায়ু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ৫.৮–৫.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধনী অধিবেশনে ছয়টি নতুন প্রস্তাব পেশ করেন—এর মধ্যে ছিল জি-২০ ঐতিহ্যগত জ্ঞানভাণ্ডার, আফ্রিকা স্কিলস মাল্টিপ্লায়ার প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্যজরুরি প্রতিক্রিয়া দল, ওপেন স্যাটেলাইট ডেটা পার্টনারশিপ, ক্রিটিক্যাল মিনারেল সার্কুলারিটি ও ড্রাগ–টেরর নেক্সাস মোকাবিলা। ফেন্টানিল পাচারকে তিনি আন্তর্জাতিক  নিরাপত্তার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ বলেন।

মোদি আবারও “গ্লোবাল সাউথ”-এর কণ্ঠ জোরদারের আহ্বান জানান এবং তার বক্তৃতায় তুলে ধরেন “সমন্বিত মানবতাবাদ”—যা জনসংঘ নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের প্রণীত বিজেপির মূল আদর্শ। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, ব্যক্তি, সমাজ ও প্রকৃতিকে একই সমন্বিত দৃষ্টিতে দেখাই উন্নয়ন ও প্রকৃতির মধ্যে সুষমতা আনে।

সামগ্রিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্জন, প্রোটোকল বিতর্ক, এবং ঘোষণার নরম ভাষা—সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গ জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি করেছে।