আজকাল ওয়েবডেস্ক: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তীব্র সৌরঝড়ের আঘাতে কেঁপে উঠেছে, ফলে বিশ্বজুড়ে স্যাটেলাইট ও বিদ্যুৎ গ্রিডগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ১১ নভেম্বর সূর্যের দিক থেকে পরপর দুটি করোনাল মাস ইজেকশন পৃথিবীতে এসে পৌঁছালে G4 শ্রেণির এক বিরল জিওম্যাগনেটিক ঝড় তৈরি হয়। এই তীব্র সৌরঝড়ের ফলে শক্তিশালী কণার প্রবাহ পৃথিবীতে আঘাত হানে, যার প্রভাবে আকাশে উজ্জ্বল অরোরা বা ‘নর্দার্ন লাইটস’ দেখা যায়— এমনকি দক্ষিণের ফ্লোরিডা, টেক্সাস ও আলাবামা পর্যন্ত।
এই ঝড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে সূর্যের ৪২৭৪ নম্বর সানস্পট থেকে এক বিশাল সৌর জ্বালা বিস্ফোরিত হয়, যা প্রচণ্ড গতিতে চার্জিত প্রোটন পৃথিবীর দিকে নিক্ষেপ করে। এর মধ্যে কিছু কণা এতই শক্তিশালী ছিল যে, তারা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূমির কাছাকাছি স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
স্যারি স্পেস সেন্টারের অধ্যাপক ক্লাইভ ডায়ার এই ঘটনাকে “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, বিশ্বজুড়ে নিউট্রন মনিটরগুলো অস্বাভাবিকভাবে কসমিক রশ্মির মাত্রা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা “গ্রাউন্ড লেভেল ইভেন্ট” নামে পরিচিত এক বিরল সৌর বিকিরণ ঘটনার প্রমাণ। সাধারণত প্রতি সৌরচক্রে এক বা দুইবার এমন ঘটনা ঘটে থাকে।
অধ্যাপক ডায়ার বলেন, “এই ঘটনার গুরুত্ব ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বরের GLE-এর সঙ্গে তুলনীয়— এটি একপ্রকার ২০ বছরের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া বিরল সৌরঘটনা।” ২০০৬ সালের ঘটনায় উচ্চ অক্ষাংশের ফ্লাইটে যাত্রীদের বিকিরণমাত্রা প্রায় ৩০ মাইক্রোসিভার্ট প্রতি ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান সৌরঝড়ের কারণে মেরু অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানে বিকিরণমাত্রা আবারও বেড়ে যেতে পারে। ডায়ারের মতে, এইবারের GLE অধ্যয়ন করলে ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ সৌর বিস্ফোরণের প্রস্তুতির জন্য মূল্যবান তথ্য পাওয়া যাবে— যেমন ১৯৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক সৌরঘটনা, যা উচ্চ বায়ুমণ্ডলে বিকিরণমাত্রা প্রায় এক হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এই সৌরঝড়ের প্রভাব শুধু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ নয়; কক্ষপথে থাকা অসংখ্য স্যাটেলাইটেও এর প্রভাব পড়ছে। তীব্র সৌরপ্রোটন প্রবাহ স্যাটেলাইটের পৃষ্ঠ ও ইমেজিং সিস্টেমে আঘাত করছে, ফলে তথ্য বিকৃতি ও কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
সম্প্রতি ধারাবাহিকভাবে একাধিক CME নির্গত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের NOAA (ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) মহাকাশ আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা জারি করেছেন। তীব্র জিওম্যাগনেটিক ঝড় রেডিও যোগাযোগ, স্যাটেলাইট GPS, এমনকি মেরু অঞ্চলের বিমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়ও বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
যদিও উত্তর আমেরিকার অনেক জায়গায় মানুষ চমৎকার অরোরার দৃশ্য উপভোগ করছে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন— এই সৌরঝড় কেবল আকাশের সৌন্দর্য নয়, মারাত্মক ক্ষতিও ঘটাতে পারে। সৌরবায়ু ও চার্জিত প্লাজমা বিদ্যুৎ গ্রিডে অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা বড় ধরনের ব্ল্যাকআউটের কারণ হতে পারে। ইতিহাসে এমন ঘটনাও ঘটেছে— ১৮৫৯ সালের ক্যারিংটন ইভেন্ট টেলিগ্রাফ সিস্টেম পুড়িয়ে দেয়, আর ১৯৭২ সালের সৌরঝড় ভিয়েতনামের উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর মাইন বিস্ফোরণ ঘটায়।
যদিও এখন মহাকাশ আবহাওয়া পূর্বাভাস অনেক উন্নত, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী এখনো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এমন সৌরঝড় পৌঁছানোর আগে সাধারণত কয়েকদিনের বেশি সতর্কতা দেওয়া যায় না।
বর্তমান সৌরচক্র তার শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে, তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন— সতর্ক নজরদারি ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াই এমন মহাজাগতিক বিস্ফোরণের ক্ষতি কমানোর একমাত্র উপায়।
