আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা পরিণত হয়েছে এক গ্লোবাল হেলথ ইমার্জেন্সি বা জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থায়। সাম্প্রতিক এক বিস্তৃত রিপোর্ট জানাচ্ছে, চরম তাপপ্রবাহ, ভয়াবহ বন অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া, ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া উষ্ণমণ্ডলীয় রোগ এখন প্রতি বছর লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণও বাড়িয়ে দিচ্ছে অসংখ্য রোগ ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা।
১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, তাপজনিত মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য বলছে, শিশু ও প্রবীণরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছেন বিপজ্জনক তাপমাত্রায়। শুধু ২০২৪ সালেই বিশ্বব্যাপী বন অগ্নিকাণ্ডজনিত ধোঁয়ার কারণে ১.৫৪ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। এই মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল PM 2.5—অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের বায়ু দূষণ কণা, যা শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে গভীর ক্ষতি করে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ড. মারিনা রোমানেলো, লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের গবেষক। তিনি জলবায়ু ঝুঁকির ডেটাকে বাস্তব স্বাস্থ্যনীতিতে রূপান্তর করার কাজ করেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ প্রায় ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, অর্থাৎ উষ্ণতা ও আর্দ্রতা এখন ভাইরাসের বিস্তারের জন্য আরও উপযোগী হয়ে উঠছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছে না, বরং মানবদেহেও চিরস্থায়ী মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিনের চরম তাপ, দূষিত বায়ু এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট উদ্বেগে শরীরে কোরটিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়—যা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং স্মৃতিশক্তির অবনতির মতো জটিল সমস্যা ডেকে আনে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথের গবেষণা বলছে, তাপপ্রবাহ, বন্যা বা অগ্নিকাণ্ডের পর পরিবেশগত চাপ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘ইকো-অ্যাংজাইটি’ বা জলবায়ু-ভীতি দ্রুত বাড়ছে—কারণ তারা নিজেদের ভবিষ্যৎকে ক্রমশ অনিশ্চিত হিসেবে দেখছে।
অন্যদিকে, পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহারে বৈষম্যও গভীর। নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে আজও অনেক মানুষ রান্নার জন্য বায়োমাস বা কাঠ, কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এতে শুধু দূষণই বাড়ে না, বরং তাপপ্রবাহ, খরা বা বন্যার সময় স্বাস্থ্যঝুঁকিও বহুগুণ বেড়ে যায়। যথাযথ অর্থায়ন ও পরিকল্পনা থাকলে অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন উদ্যোগ এই বৈষম্য কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
ড. রোমানেলোর মতে, “জীবাশ্ম জ্বালানি দ্রুত পর্যায়ে বন্ধ করাই জলবায়ু পরিবর্তন থামানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় এবং এর মাধ্যমে লাখ লাখ জীবন রক্ষা করা সম্ভব।” তিনি বলেন, এখনই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুলোকে তাপপ্রবাহ মোকাবিলা পরিকল্পনা, ধোঁয়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও হাসপাতালের প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে।
বিশ্বের বহু শহর ইতিমধ্যেই জলবায়ু ঝুঁকি মূল্যায়ন শুরু করেছে, এবং চিকিৎসা শিক্ষায়ও ‘ক্লাইমেট হেলথ’ প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক প্রতিরোধ এখনো অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্বই আশার আলো দেখাচ্ছে।
২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের নিজস্ব কার্বন নির্গমনও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, যা প্রমাণ করে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করলে পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু এখনো ব্যাংক ঋণনীতি ও জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নিরাপদ তাপমাত্রা সীমার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
রিপোর্টের উপসংহার স্পষ্ট—জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশ নয়, মানবজীবনের কেন্দ্রবিন্দুকেও আঘাত করছে। এই বিপদকে উপেক্ষা করলে, আগামী প্রজন্মকে শুধু গরম পৃথিবী নয়, অসুস্থ জীবনও উত্তরাধিকার হিসেবে পেতে হবে।
