আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভাবুন, আপনি নিজের চোখে ভূমির জন্ম দেখছেন। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সমুদ্রের নিচে এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ধীরে ধীরে তৈরি করতে শুরু করল একটি সম্পূর্ণ নতুন দ্বীপ—ম্যাগমা, ধোঁয়া ও ছাই থেকে জন্ম নেওয়া এক নবজাত ভূমি। কয়েক মাসের মধ্যেই, সেই দ্বীপটি সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপরে মাথা তোলে। নাম দেওয়া হয়—সুরতসেই।


দ্বীপে তখন কোনও মাটি নেই, নেই গাছপালা, ঘাস কিংবা জীবনের কোনও চিহ্ন। কেবল কালো আগ্নেয়শিলা, ধোঁয়াময় গরম পাথর, আর নিস্তব্ধতা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে এটি ছিল এক আশ্চর্য উপহার—একটি সম্পূর্ণ নতুন জগৎ, যা শূন্য থেকে জীবনের গল্প লিখতে শুরু করছে।


তাদের মনে প্রশ্ন জাগল—প্রথম কে আসবে? জীবনের কোন নিয়মগুলো কার্যকর হবে যখন ইতিহাস বা পূর্বসূরি বলে কিছুই নেই? গাছ কি অপেক্ষা করবে বাতাসের জন্য, যে বীজ বয়ে আনবে? নাকি প্রকৃতি গোপন কোনও সহযোগিতার মাধ্যমে নিজের কাজ সম্পন্ন করে, যা আমরা সাধারণত দেখি না?


দশকের পর দশক ধরে পরিবেশবিদরা বিশ্বাস করতেন, এমন নতুন দ্বীপে প্রথম বসতি গড়ে তোলার ক্ষমতা কেবল বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদেরই থাকে। যাদের বীজ হালকা, বাতাসে উড়ে যেতে পারে, কিংবা রসালো ফল থাকে যা প্রাণীদের আকর্ষণ করে ও তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, প্রকৃতি “নকশা অনুযায়ী” পুরস্কৃত করে।

আরও পড়ুন: ঘুমিয়ে ছিল ৪৬ হাজার বছর, এরপরই ‘জীবিত’ প্রত্যাবর্তন, বিজ্ঞানীরা হতবাক


কিন্তু সুরতসেই দ্বীপে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রমাণিত হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতি বছর উদ্ভিদবিদরা দ্বীপে ফিরে আসেন এবং প্রতিটি উদ্ভিদের আগমন সূক্ষ্মভাবে লিপিবদ্ধ করেন। সেই তথ্য থেকে উঠে আসে এক বিস্ময়কর সত্য—যেসব উদ্ভিদ দ্বীপে আসছিল, তাদের বেশিরভাগেরই কোনও বিশেষ বীজবহন বৈশিষ্ট্য ছিল না। না বাতাসে ওড়ার মতো তুলোর মতো গঠন, না প্রাণীদের খাওয়ার মতো ফল। অর্থাৎ, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তাদের কখনোই ৩০ কিলোমিটার দূরের সমুদ্র পার হওয়া সম্ভব ছিল না।


তবুও তারা এসেছে—এবং আসতেই থেকেছে। আজ সুরতসেই দ্বীপে ৭৮ প্রজাতির উদ্ভিদ বসতি গড়ে তুলেছে, যাদের বেশিরভাগই “দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রমে অযোগ্য” বলে মনে করা হতো। তাহলে তারা এল কীভাবে? উত্তরটা মাটি নয়, আকাশে লুকিয়ে ছিল।


দ্বীপ গঠনের পর থেকেই অসংখ্য গাঙচিল, হাঁস ও উপকূলীয় পাখি সেখানে আসা শুরু করে। তারা দ্বীপটিকে বিশ্রামের জায়গা, খাদ্য অনুসন্ধানের স্থান হিসেবে ব্যবহার করত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—তারা ফাঁকা পেটে আসেনি। তাদের দেহের ভেতরেই ছিল বীজ!


আইসল্যান্ডের ন্যাচারাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. পাওয়েল ওয়াসোভিজ বলেন, “সুরতসেইয়ের প্রকৃত অগ্রদূত ছিল পাখিরা। তারা এমনসব উদ্ভিদের বীজ বহন করেছে, যেগুলোর পক্ষে এখানে পৌঁছানো অসম্ভব বলে ধরা হতো।” তিনি আরও বলেন, “এই ফলাফল আমাদের প্রচলিত ধারণাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। জীবন কখনও একা চলাচল করে না—জীবন সবসময় জীবনের সঙ্গেই চলাফেরা করে।”


বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, উদ্ভিদের ছড়িয়ে পড়ার জন্য ফল বা বাতাসের প্রয়োজন সবসময় হয় না। বহু শুকনো বীজ বিশিষ্ট উদ্ভিদ পাখির পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়েও টিকে থাকতে পারে। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রক্রিয়া বীজ অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।


অর্থাৎ, এটি কোনো এককালীন ঘটনা নয়—এটি প্রকৃতিরই একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। সুরতসেই আজ সেই জীবন্ত প্রমাণ, যেখানে আগুন ও ছাই থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন ভূমি, আর পাখিদের ডানায় ভেসে এসেছে জীবন। তাই পাখিদের অবহেলা করবেন না। তারাই গড়ে তুলতে পারে উদ্ভিদের জীবন। সেখান থেকে তৈরি হতে পারে নতুন প্রাণের স্পন্দন।