আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের বিধানসভা নির্বাচন এখন অর্ধেক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ভোটের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার প্রাক্কালে ফলাফল নিয়ে এখনই কোনও  পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। অধিকাংশ বিশ্লেষকই বলছেন—এবার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে। রাজ্যের ভয়াবহ সামাজিক–অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ততটা সরল নয়।

বিহার আজও জাতপাতভিত্তিক রাজনীতি ও সামাজিক বিভাজনে জর্জরিত। ফলে ভোটারদের সিদ্ধান্ত অনেক সময় অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে সামাজিক আনুগত্য বা স্বল্পমেয়াদি প্রলোভনের ওপর নির্ভর করে। নগদ অর্থসাহায্য ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রলোভন  সহজেই বিরোধী মনোভাবকে স্তিমিত করে দিতে পারে। উপরন্তু, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় ভোটের ফল অনুমান করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

তবু, যদি শুধুমাত্র রাজ্যের অবস্থা ও শাসকদের কর্মক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে বিচার করা হয়, তাহলে বিহারের মানুষের এখন হতাশা ও ক্ষোভের চরমে থাকারই কথা।

অর্থনীতি

২০২৩–২৪ অর্থবর্ষে বিহারের প্রতি ব্যক্তি মোট রাজ্য আয় (NSDP) ছিল মাত্র ₹৬০,৩৩৭, যা ভারতের গড় (₹১,৮৪,৯০৩)-এর প্রায় ৩০ শতাংশ। এটি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।

দারিদ্র্যের হারও ভয়াবহ—নীতি আয়োগের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (২০২৩) অনুযায়ী, বিহারের ৩৩.৮ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ ৩ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি নাগরিক, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে ভুগছেন। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ বিহারে বাস করলেও, দেশের মোট দরিদ্রের ২৭ শতাংশ এখানেই।

বেকারত্বের হার (PLFS ২০২২–২৩) শহরাঞ্চলে ১৩.৪ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ৬.১ শতাংশ-এর দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২৪ সালের PLFS তথ্য বলছে, বিহারের সামগ্রিক বেকারত্ব জাতীয় গড়ের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি।

শিক্ষা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বিহারের সাক্ষরতার হার ৬১.৮ শতাংশ, যা ভারতের মধ্যে সর্বনিম্ন। পুরুষদের সাক্ষরতা ৭১.২ শতাংশ, নারীদের মাত্র ৫১.৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের NSO অনুমান অনুযায়ী সামান্য উন্নতি হলেও, জাতীয় গড় (৭৪ শতাংশ)-এর অনেক নীচে রয়েছে বিহার।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

বিহারের শিশুমৃত্যুর হার (IMR) প্রতি হাজারে ২৭, যা জাতীয় গড় (১২)-এর দ্বিগুণেরও বেশি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (NFHS-5) অনুসারে, রাজ্যের ৪৩ শতাংশ শিশু খর্বাকৃত (stunted) এবং ৩২.৫ শতাংশ অপুষ্টিতে (wasted) ভুগছে।

মহিলাদের অ্যানিমিয়ার হার ৬৩.৫ শতাংশ, যা ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২০–২৫ সালের মধ্যে বিহারের গড় আয়ু ৬৮.১ বছর, যা জাতীয় গড় (৭০.২ বছর)-এর নিচে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-র মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) অনুযায়ী, বিহারের HDI ০.৬১৩, যা ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বশেষ স্থানে। ভারতের গড় ০.৬৩৩ এবং সর্বোচ্চ রাজ্য কেরলের সূচক ০.৭৯০।

অভিবাসন ও বৈষম্য

কর্মসংস্থানের অভাবে ১ থেকে ৩ কোটি বিহারবাসী অন্য রাজ্যে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে এই ব্যাপক বহির্গমন  একাধিকবার আলোচনায় এসেছে।

কিন্তু অন্যদিকে, বিহারের বর্তমান বিধায়কদের ঘোষিত মোট সম্পত্তির পরিমাণ ₹১,১২২ কোটি, অর্থাৎ গড়ে প্রতি বিধায়কের সম্পদ ₹৪.৬৫ কোটি। সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের এই তীব্র বৈপরীত্য রাজ্যের গভীর সংকটকেই প্রতিফলিত করে।


পরিবর্তনের ডাক

এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন তেজস্বী যাদব, যিনি ‘নয়া বিহার’-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাগঠবন্ধন-এর স্লোগান শুধুমাত্র ‘বদলো সরকার’ নয়, বরং ‘বদলো বিহার’।

তবে রাজ্যের দীর্ঘদিনের সামাজিক বিভাজন, প্রশাসনিক পক্ষপাত ও অর্থনৈতিক দুর্দশার জট খুলে সত্যিকারের উন্নয়ন ঘটানো কতটা সম্ভব, তা এখনই বলা কঠিন।

বিহার আজ এক দ্বিধাবিভক্ত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—একদিকে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে পুরোনো বাস্তবতার গভীর শিকড়। নির্বাচনের ফলাফল তাই কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাজ্যের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশও নির্ধারণ করবে।