আজকাল ওয়েবডেস্ক: পসপোলজিস্ট সঞ্জয় কুমারের দুটি টুইট মুছে ফেলার ঘটনাই যেন মহারাষ্ট্রের ভোটার তালিকাকে ঘিরে তীব্র আলোচনার সূত্রপাত ঘটাল। যদিও তাঁর দেওয়া সুনির্দিষ্ট তথ্য পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু এর ফলে সামনে এসেছে এমন এক প্রশ্ন যা এতদিন আড়ালে ছিল—মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে মহারাষ্ট্রের ভোটার তালিকা এতটা বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা কী? ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পর একই বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হয় বিধানসভা ভোট। বিরোধীদের দাবি, এই স্বল্প সময়ে প্রায় এক কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে এবং এটি কোনো স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ফল নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত কারচুপির প্রমাণ। রাহুল গান্ধী সহ বিরোধী নেতারা একে সরাসরি “Vote Theft” বা ভোট চুরি বলে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বর ২০২৪-এ স্পষ্ট করে জানায়, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মোট নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে ৪০.৮ লক্ষ, এর মধ্যে প্রায় ২৭ লক্ষ তরুণ-তরুণী প্রথমবারের মতো নাম তুলেছেন ভোটার তালিকায়। কমিশন দাবি করে, এই বৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে নিয়মিত হালনাগাদ প্রক্রিয়ার অংশ এবং এর সঙ্গে কারচুপির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু কমিশনের দেওয়া সংখ্যাই খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ভোটার বৃদ্ধির হার সর্বত্র সমান ছিল না, বরং কয়েকটি অঞ্চল, জেলা ও নির্বাচনী কেন্দ্রে বৃদ্ধি এতটাই বেশি হয়েছে যে সেটিকে সহজ ব্যাখ্যায় মেলানো যায় না।
তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম মহারাষ্ট্র ও কোনকন অঞ্চলে ভোটার বৃদ্ধির হার সর্বাধিক, যথাক্রমে ৪.৬ এবং ৪.৫ শতাংশ। এর তুলনায় মরাঠওয়াড়ায় বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ। আবার জেলা স্তরে তাকালে দেখা যায়, কল্যাণে ভোটার সংখ্যা এক ধাক্কায় বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি, ঠাণেতে ৬.৯ শতাংশ এবং শিরুরে ৬.৫ শতাংশ। অন্যদিকে মুম্বই সাউথ সেন্ট্রাল ও গড়চিরোলি-চিমুর জেলার মতো এলাকায় বৃদ্ধি ২ শতাংশেরও নিচে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ চিত্র ফুটে উঠছে আসনভিত্তিক বিশ্লেষণে। মাত্র পাঁচ মাসে ডোম্বিভলির ভোটার তালিকা ফুলে উঠেছে ১৩.৮ শতাংশ, মালেগাঁও সেন্ট্রালে ১৩.৩ শতাংশ এবং কল্যাণ রুরালে ১২.৬ শতাংশ। এই ধাক্কাধাক্কি বৃদ্ধি প্রশাসনিক পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি পানভেল আসনে ১০ শতাংশেরও বেশি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে, আর এই এলাকাতেই এখন ভোটার ডুপ্লিকেশনের অভিযোগ জোরদার।
রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে একটি জটিল চিত্র সামনে আসে। মহায়ুতি জোটের জেতা আসনে গড় ভোটার বৃদ্ধি হয়েছে ৪.২ শতাংশ, মহা বিকাশ আঘাড়ি বা এমভিএ-র আসনে গড় বৃদ্ধি ৩.৭ শতাংশ, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি দেখা গেছে ‘অন্যান্য’ প্রার্থীদের জেতা আসনে, যেখানে বৃদ্ধির হার ৫.৪ শতাংশ। এর ফলে এটি স্পষ্ট যে ভোটার তালিকা বৃদ্ধির প্রবণতা কেবলমাত্র এক রাজনৈতিক শক্তিকে সুবিধা দিয়েছে এমন নয়, বরং এর ভেতরে বহুস্তরীয় প্রভাব কাজ করছে।
এই পটভূমিতেই সঞ্জয় কুমারের মুছে ফেলা টুইট আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁর তথ্য ভুল হলেও তা সাধারণ মানুষের চোখে প্রশ্ন তুলেছে—এত বিপুল হারে ভোটার বৃদ্ধির পেছনে প্রকৃত কারণ কী? বিরোধীরা বলছে, এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করছে নির্বাচনী কারচুপি ও কৃত্রিম ভোটার তৈরির চক্রান্ত। অন্যদিকে শাসক শিবির এই অভিযোগকে ‘আবেগের রাজনীতি’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে এক বিষয় স্পষ্ট—মহারাষ্ট্রে ভোটার বৃদ্ধির অস্বাভাবিক ধারা এখন স্রেফ প্রশাসনিক হিসাবের বাইরে চলে গিয়ে বড় রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। কোন অঞ্চলে কত ভোটার যোগ হয়েছে তার মানচিত্র ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে, আর সেখানেই সামনে এসেছে নাটকীয় বৈষম্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বৃদ্ধির কারণ শুধুই প্রশাসনিক ত্রুটি, নাকি এর পেছনে সত্যিই কোনও গোপন কৌশল লুকিয়ে আছে? আসন্ন সময়ে তদন্ত, সাংবাদিক অনুসন্ধান ও জনচাপই এই প্রশ্নের উত্তর বের করে আনতে সক্ষম হবে।
অর্থনীতির দিক থেকেও এই বৈষম্য ব্যাখ্যা করা যায়। দ্রুত নগরায়ণ, জমি বিক্রির জোয়ার, আবাসন প্রকল্প ও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকের ঢল—সবকিছু মিলিয়ে কল্যাণ, ঠাণে, পানভেল বা মালেগাঁওয়ের মতো কেন্দ্রে এক নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতি গড়ে উঠছে। এই নতুন ভোটাররা স্থানীয় রাজনীতির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। এর বিপরীতে পশ্চাৎপদ কৃষি অঞ্চলগুলো ক্রমশ জনশূন্য হচ্ছে, যা সেখানকার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকে দুর্বল করে তুলছে।
ফলে মহারাষ্ট্রের ভোটার বৃদ্ধির বিতর্ককে কেবল প্রশাসনিক গাফিলতি বা কারচুপি হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়। এটি আসলে এক বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন, যেখানে অভিবাসন, নগরায়ণ ও শিল্পভিত্তিক শ্রমবাজার সরাসরি প্রভাব ফেলছে নির্বাচনী পরিসংখ্যানে। বিরোধী ও শাসক দুই পক্ষই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী এই প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করছে, কিন্তু বাস্তবে এটি মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতির চলমান রূপান্তরেরই একটি লক্ষণ।
