আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারত গত এক দশকে নজিরবিহীন উষ্ণায়নের মুখোমুখি হয়েছে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটির গড় তাপমাত্রা বিংশ শতকের শুরুর তুলনায় প্রায় ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। peer-reviewed এই গবেষণা জানিয়েছে—উষ্ণায়নের এই ধারা ভারতে আবহাওয়ার ধরন বদলে দিচ্ছে এবং চরম আবহাওয়া আরও ঘন ঘন ঘটাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এখনই শক্তিশালী অভিযোজন (adaptation) ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সবচেয়ে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে বছরের সবচেয়ে গরম দিন

গবেষণা বলছে, দেশের বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার দিনটি জাতীয় গড় তাপমাত্রার তুলনায় আরও দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে পশ্চিম ভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতে এই দিনটির তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। উভয় অঞ্চলই আগে থেকেই তীব্র তাপপ্রবাহঝুঁকিতে ছিল।

বহু প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণা

গবেষকরা এসেছেন ক্ৰিয়া ইউনিভার্সিটি, সাভিত্রীবাই ফুলে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়, Indian Institute of Tropical Meteorology, নরওয়ের Institute of Marine Research এবং নেপালের ICIMOD থেকে। তারা সর্বশেষ পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য ও উন্নত জলবায়ু মডেল ব্যবহার করে ভারতের উষ্ণায়নের একটি আধুনিক চিত্র তুলে ধরেছেন।

বেশি গরম দিন, তীব্রতর তাপপ্রবাহ

গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত উষ্ণায়নের কারণে ভারতে এখন প্রতি দশকে অতিরিক্ত ৫–১০টি গরম দিনের যোগ হচ্ছে। এসব তাপপ্রবাহ শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নয়, কৃষি, জলসম্পদ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপরও বড় ধরনের চাপ তৈরি করছে।

দেশজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু সংকট

গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলভিত্তিক বিপদের একটি সূক্ষ্ম চিত্র উঠে এসেছে:

হিন্দুকুশ হিমালয়: দ্রুত উষ্ণায়ন ও  হিমবাহ গলন

ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি: তাপ বৃদ্ধি ও জুন–সেপ্টেম্বর বর্ষায় বর্ষণ কমে যাওয়া

উত্তর-পশ্চিম ভারত: উষ্ণ দিন ও উষ্ণ রাতের সংখ্যা বাড়ছে

পশ্চিম ভারত: চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনা বাড়ছে, পাশাপাশি গরম দিন-রাতও বৃদ্ধি

পশ্চিম উপকূল ও আরব সাগর: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি, অস্বাভাবিক গতিতে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি

উত্তর-পূর্ব ভারত: বর্ষায় কম বৃষ্টি, উষ্ণ রাত-দিনের সংখ্যা বেশি

সুন্দরবন: দ্রুত সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির সঙ্গে ভয়াবহ তাপ

মধ্য ভারত: চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনাবৃদ্ধি

দক্ষিণ-পূর্ব ভারত: উষ্ণ দিন-রাত বাড়ছে, পূর্বোত্তর মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত


সবচেয়ে উদ্বেগজনক: বহু-ঝুঁকি বা compound climate events

গবেষকদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো compound events—অর্থাৎ একই সময়ে বা পরপর একাধিক জলবায়ু বিপর্যয়। যেমন:

তাপপ্রবাহ + খরা

চরম বৃষ্টি + বন্যা

সাইক্লোন + সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি


এমন যৌথ বিপর্যয় জরুরি ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে এবং জল, খাদ্য, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ক্রমাগত ধস নামাতে পারে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

ভারতের আশেপাশের সাগরও দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে

গবেষণায় দেখা গেছে, উষ্ণমণ্ডলীয় ভারত মহাসাগর প্রতি দশকে ০.১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে উষ্ণ হচ্ছে—বিশ্বের দ্রুততম উষ্ণায়িত সাগরগুলোর একটি এটি।

বর্তমানে বছরে প্রায় ২০ দিনের সমুদ্র তাপপ্রবাহ (marine heatwave)

২০৫০ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২০০ দিন হতে পারে


এর ফলে প্রবালপ্রাচীর, মাছের প্রজাতি ও সমুদ্রনির্ভর জীবিকার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।

আরব সাগর: নতুন সাইক্লোন হটস্পট

আরব সাগরে প্রাক-মৌসুম সাইক্লোনের তীব্রতা সাম্প্রতিক দশকে ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
উচ্চ সমুদ্রপৃষ্ঠ এর প্রভাব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে—
যে সাগর-জলোচ্ছ্বাস আগে শত বছরে একবার দেখা যেত,
২০৫০ সালের মধ্যে তা প্রতিবছর ঘটতে পারে।

‘অভিযোজন আর বিলাসিতা নয়, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন’

গবেষকরা বলেছেন, ভারতকে এখনই—

অঞ্চলভিত্তিক অভিযোজন পরিকল্পনা

জলবায়ু-সহনশীল কাঠামো

বহু-ঝুঁকি আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা

চরম আবহাওয়ার উপযোগী কৃষি-পদ্ধতি


—এগুলোতে দ্রুত বিনিয়োগ করতে হবে।

তাদের মতে, চরম গরম, অস্থির বৃষ্টি, ঘন ঘন সাইক্লোন এবং সাগরের জীববৈচিত্র্য ধসে পড়ার মতো সংকটের মুখে জলবায়ু অভিযোজন আর ঐচ্ছিক নয়।

এটি এখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতি এবং জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি অপরিহার্য অগ্রাধিকার।