আজকাল ওয়েবডেস্ক: এ হল আলো থেকে আঁধারে প্রবেশের বাস্তব গল্প, জানলে শিউরে উঠতে হয়। ছত্তিশগড়ের বস্তরের একটি গ্রাম বাকাওয়ান্দের বাসিন্দা লিসা। ছোট বয়সেই মাকে হারিয়েছিল। বাবা ভাগচাষী, ক্ষমতা নিতান্তই। বেড়ে উঠছিল লিসা। মাঝে গ্রামেরই কেউ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এতেই লিসার জীবন ওলটপালট হয়ে পড়ে। বাবা মেয়েকে হারানোর ভয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত লিসাকে অন্ধকার মাটির ঘরে বন্ধি করা হয়। সেই ঘরে সূর্যের আলো ঢুকত না, নিকশ কালো। দিনের বেলা ও রাতে শুধু ওই ঘরের দরজা খুলে মেয়েটিকে খাবার দেওয়া হত। দীর্ঘ দু'দশক এভাবেই কেটেছিল লিসার। শেষমেষ প্রশাসন সব জেনে সিলাকে উদ্ধার করছে। কিন্তু, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে লিসার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। স্মূতিশক্তিও তেমন বাড়েনি। 

লিসার বন্দিদশা শুরু হয়েছিল আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। ২০০০ সালে, যখন সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ত, তখন তারই গ্রামের এক ব্যক্তি তাকে হত্যার হুমকি দেয়। যা তাকে এতটাই আতঙ্কিত করে যে, সে থম মেরে ছিল। এতে লিসার কৃষক বাবা, ভীত, সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েন। মেয়ের কোনও সহায়তা, সুরক্ষার উপায় না দেখে, বাবা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, নেয়েকে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখেন।  

অন্ধকার বিপদকে দূরে রাখবে, লিসার বাবা মেয়েকে এই বিশ্বাসে তাঁদের মাটির ঘরে আটকে রেখেছিলেন। জানালাবিহীন একটি ঘরই সেই থেকে লিসার পৃথিবী। সূর্যের আলো নেই। কোন কথাবার্তা নেই। কোন মানুষের স্পর্শ নেই। দরজায় শুধু সময়মত পৌঁছত খাবার।

বাঁচানোর জন্য তাঁর বাবার পদক্ষেপই শেষপর্যন্ত লিসার জীবনে কাল হয়ে উঠল। বর্তমানে লিসার বয়স প্রায় ২৬ বছর।

খবর পেয়ে সমাজকল্যাণ বিভাগের দল যখন ওই কুঁড়েঘরে প্রবেশ করে, তখন এক মহিলাকে দেখতে পাওয়া যায়। মহিলার দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ।
চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘ দিন প্রাকৃতির আলোর সংস্পর্শে না আসায় লিসার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। যা পুরদুদ্ধারের সম্ভাবনাও খুবই কঠিন। লিসার মানসিক বিকাশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে নিজের বয়সের তুলনায় অনেক কম বয়সীদের মতো আচরণ করেন।

লিসা নিজের নামও বুঝতে পারছিলেন না। ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছিলেন না। অন্ধকার ঘরে একা থাকতে থাকতে, কারোর সঙ্গে না মিশতে পারায় লিসা এখন প্রতিটি শব্দকে ভয় পায়, প্রতিটি স্পর্শকে প্রতিরোধ করত চেষ্টা করেন।

লিসাকে উদ্ধারের পর, তাঁর শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষার জন্য জগদলপুরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার ফলাফলে ছন্নছাড়া বঞ্চনার শৈশবের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

সমাজকল্যাণ বিভাগ গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। সরকারি কর্মীরা এখন লিসার পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা, কেন লিসাকে ২০ বছর ধরে আটকে রাখা হল?

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, "তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হওয়ার পর আমরা ব্যবস্থা নেব।" খতিয়ে দেখা হচ্ছে যে, ভয় এবং অজ্ঞতার কারণে তাঁর বাবা স্কুল, পঞ্চায়েত সংস্থা বা স্বাস্থ্যসেবা থেকে সাহায্য নিতে ব্যর্থ হয়েছেন কিনা। 

কুঁড়েঘর থেকে উদ্ধারের পর লিসা এখন ঘরৌন্ডা আশ্রমে বসবাস করছেন। পরমযত্নে জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করছেন আশ্রমের কর্মীরা। সে এখন ধীরে ধীরে ফের হাসতে, মানুষের উপস্থিতিতে বিশ্বাস করতে, দ্বিধা না করে এগিয়ে যেতে, খেতে, অন্যের সাহায্য নিয়ে স্নান করতে এবং কথা বললে সাড়া দিতে শিখছে।

চিকিৎসক এবং শুভান্যুধায়ীরা আশাবাদী। তবে লিসার দৃষ্টিশক্তি ফিরে নাও আসতে পারে। তবে চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন যে, লিসার মানসিক এবং আচরণগত পুনরুদ্ধার এখনও সম্ভব। তবে এতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। সমাজকল্যাণ বিভাগের উপ-পরিচালক সুচিত্রা লাকরা বলেছেন, "আমরা জানতে পেরেছি যে মেয়েটি বাকাওয়ান্দ ব্লকে ছিল। সে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। আমরা তাঁকে উদ্ধার করেছি এবং এখন সে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে।" 

লাকরা বলেন, "সে (লিসা) একাকীত্বে সবকিছু হারিয়েছে। আমরা যখন তাঁকে উদ্ধার করি, তখন সে মানুষের ভয়ে ভীত ছিল। তাঁর বাবা বৃদ্ধ এবং তাঁকে একটি ঘরে আটকে রেখেছে যাতে কেউ তাঁর দিকে তাকাতে না পারে। সে এখন নিরাপদ। সে আশ্রয়কেন্দ্রে একা খায়, স্নান করে এবং কথা বলে।" , 

সমাজকল্যাণ বিভাগের উপ-পরিচালকের কথায়, "লিসার দাদা এবং বৌদি পাশেই থাকতেন কিন্তু তাঁরা বোনের যত্ন নিতেন না। তাঁর মা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। প্রথমদিকে সে একজন সাধারণ মেয়ে ছিল, সে স্কুলে যেত, সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সেই সময় একজন লোক তাঁকে বলেছিল যে, সে তাঁকে মেরে ফেলবে। তারপর থেকে সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, মানুষের সঙ্গে দেখা ককরত না। লিসা দেবীর বাবা নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেছিলেন, তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন, দয়া করে আমার যত্ন নিন। এভাবেই আমরা তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি।"

"শৈশবের আঘাত এখনও জমাট, তবে লিসা এখন জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। অনুরাগ পেলেই লিসার মনের গভীরতম ক্ষতগুলি কমতে শুরু করবে। সে হয়তো আর কখনও পৃথিবী দেখতে পাবে না। সে হয়তো তাঁর হারিয়ে যাওয়া বিশ বছর পুরোপুরি ফিরে পেতে পারবে না। কিন্তু তাঁর আগামীকাল গতকালের মতোও হবে না। সমাজ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং মানবিদ উদ্যোগ যদি তাঁর পাশে থাকে, তাহলে লিসা ফের মাথা তুলতে পারবে।" এমনই মনে করেন সমাজকল্যাণ বিভাগের উপ-পরিচালক।