কিছু শহরের ক্ষেত্রে ‘মেল্টিং পট’ কথাটা ভীষণ রকম খাটে। এদেশে যেমন দিল্লি কিংবা কলকাতার এ তকমা প্রাপ্তি হয়েছে বহু যুগ আগেই। রাজধানী অঞ্চলে যেমন কর্মসূত্রে দেশের নানা দিক থেকে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা গড়ে তুলেছে হরেক সংস্কৃতির মিলমিশ। কলকাতাও তেমন নানা রাজ্যের বা ভিনদেশি মানুষের কল্যাণে হয়ে গিয়েছে হরেক রকম খাবারের মিলিজুলি রাজপাট। এ হেন দুই শহরই যদি হয়ে ওঠে কোনও গল্পের প্রেক্ষাপট, তবে তারও বোধহয় ‘মেল্টিং পট’ হয়ে ওঠার সাধ জাগতেই পারে!

 

 

 

 

ঠিক যেমনটা হয়ে উঠল ধর্মাটিক প্রোডাকশন্সের নতুন সিরিজ ‘ডু ইউ ওয়ানা পার্টনার?’ । অ্যামাজন প্রাইমে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া এই সিরিজের গল্প বোনা আছে দিল্লি-গুরগাঁও এবং কলকাতা জুড়ে। আর সেই কাহিনিতে? কর্পোরেটের সিঁড়িভাঙা অঙ্ক থেকে তারুণ্যের জেদে স্টার্ট আপ খোলা, উচ্চাকাঙ্খার ছুট থেকে ব্যবসাদারি শত্রুতা, দিল্লির ছুটন্ত অথচ রইসি জীবনযাপন থেকে কলকাতার আলসে বিলাসিতা, আন্ডারওয়ার্ল্ডের পেশীবহুল চোখরাঙানি থেকে সাদামাঠা স্বপ্নপূরণের খিদে, হিন্দি বলয়ের পুরুষতান্ত্রিক কাঠিন্য থেকে বাঙালির উদারমনা মিষ্টতা, নিখাদ বন্ধুত্ব থেকে সব হিসেব গুলিয়ে দেওয়া হিংসে, প্রেম থেকে হার্টব্রেক— বিনোদনের কোনও মশলাই বাদ দিতে চাননি পরিচালক জুটি কলিন ডিকুনহা এবং অর্চিত কুমার। ফলে সবটা মিলেমিশে মশলামুড়ি! বলা ভাল, মেল্টিং পট! কারণ এত কিছু মিলেমিশে মশলামুড়ির মতোই স্বাদ বেড়েছে গল্পের। 

 

 

 

 

 

কলকাতার মেয়ে, বড় হয়ে গুরগাঁওবাসী শিখা রায়চৌধুরী (তামান্না ভাটিয়া) এক ব্রিউয়ারিতে চাকরি করে। ক্ষুরধার মার্কেটিংয়ে সে সিদ্ধহস্ত। বাঙালি বাবা, অকালপ্রয়াত সঞ্জয় রায়চৌধুরী (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) ছিলেন জাত ব্রিউয়ার। বাড়ির গ্যারাজে স্রেফ নেশাতেই বানাতেন অচেনা রেসিপির দুরন্ত স্বাদের বিয়ার। সেই নেশা চারিয়ে গিয়েছিল ছোট্ট শিখার মধ্যেও। তাই একসঙ্গে ব্যবসার নামে বাবার বন্ধু-পার্টনার বিক্রম ওয়ালিয়া (নীরজ কবি) যখন ছলেবলে হাতিয়ে নেয় সেই বিয়ারের পেটেন্ট থেকে ট্রেডমার্ক, বাবাকে মনেপ্রাণে নিঃস্ব হয়ে যেতে দেখে শিখার মধ্যেও তৈরি হয়েছিল জেদ। বাবার স্বপ্নের বিয়ার রেসিপিকে একদিন সে জনপ্রিয় করে তুলবেই! 

 

 

আরও পড়ুন: জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল না মেজর মোহিত শর্মা, ‘ধুরন্ধর’-এ কার চরিত্রে রয়েছেন রণবীর?

 

 

মনের মধ্যে সেই বীজই চারাগাছ হয়ে উঠল একদিন। বিপুলায়তন বিয়ার কোম্পানি সিলভার টাস্ক শিখাদের ব্রিউয়ারিকে কিনে নেওয়ায় চাকরি গেল তার। সেই সিলভার টাস্ক-এর মাথায় আর কেউ নন, তার বাবার বিশ্বাসঘাতক বন্ধু ওয়ালিয়া। প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলে ওঠা শিখা ঠিক করল অ্যালকোহল ব্যবসার এই পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাবার রেসিপিতে তৈরি ক্রাফট বিয়ারের স্টার্টআপ সে খুলবেই। তাতে সে টেনে নিয়ে এল নিজের ছোটবেলার বন্ধু, ফাইন্যান্স উইজার্ড আনাইতা ম্যাকুজিনা (ডায়ানা পেন্টি)-কে। সেই স্বপ্নপূরণের সফরে একে একে জুটে গেল শিখার বাবার মতোই পাগলাটে, প্রতিভাধর ব্রিউমাস্টার ববি বাগ্গা (নকুল মেহতা), আনাইতার গ্রাফিক ডিজাইনার ভাই ফিরদৌস (সুফি মোতিওয়ালা) এবং শিখার ডেডিকেটেড বয়ফ্রেন্ড কবীর (রণবিজয় সিং)। 

 

 

 

 

 

 

কিন্তু সবই তো হল, টাকা কই! ক্রাফট বিয়ার তৈরি থেকে সঠিক মার্কেটিংয়ে তাকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা জনপ্রিয়তা তৈরি, সবেতেই যে বিপুল টাকার দরকার। অতএব দুই কন্যে বাজারে নেমে পড়ল পার্টনার খুঁজতে। কিন্তু সে কি মুখের কথা! হয় নতুন মুখেদের কেউ টাকা দিতে চায়না, কিংবা পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী দিল্লিওয়ালারা মদের ব্যবসায় নামা মেয়েদের কোনওরকম গুরুত্ব দিতেই নারাজ! শেষমেশ যুদ্ধের ময়দানে শিখা আর আনাইতা পেয়ে গেল তাদের তুরুপের তাস ডিলান (জাভেদ জাফরি)-কে। সঙ্গে সামিল হল লেডি ডন লায়লা সিং(শ্বেতা তিওয়ারি)-ও। ব্যবসায়িক শত্রুতার রক্তচক্ষু হেনে আসরে নামল ওয়ালিয়া-ও। 

 

 

 

 

 

এতসব পেরিয়ে কি সাফল্যের মুখ দেখবে শিখা-আনাহিতার স্টার্টআপ? কোন দিকে গড়াবে তাদের ব্যবসা থেকে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। কমেডি থেকে নাটকীয়তায়, মজাদার সংলাপে সেই গল্পই বলেছে ‘ডু ইউ ওয়ানা পার্টনার?’ বাবার স্বপ্নকে নিজের মধ্যে গেঁথে এগিয়ে চলার ছুটে, বন্ধুত্ব-প্রেমের মিষ্টি গন্ধে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর নতুন পথচলায় জড়িয়ে থাকা হিসেবের ভুলে শিখাকে ভারী জীবন্ত করে গড়ে তোলেন তামান্না। উল্টোদিকে পুরোদস্তুর কর্পোরেট লেডি, অফিসে তুমুল পরিশ্রম করে আনা সাফল্যের স্বীকৃতি না পেয়ে বন্ধুদের স্টার্টআপে যোগ দেওয়া আনাইতাকেও বিশ্বাসযোগ্য লাগে ডায়ানার অভিনয়ে। দু’জনের বন্ধুত্বের সারল্য থেকে ভুল বোঝাবুঝি তাই সবটাই যেন বাস্তব থেকে উঠে আসে। 

 

 

 

 

বিক্রম ওয়ালিয়ার চরিত্রে নীরজ যতটাই নাটকীয়, লায়লা কিংবা ডিলানকে ততটাই চেনা তারে বাঁধেন শ্বেতা আর জাভেদ। বিয়ার নিয়ে মশগুল ববি কিংবা প্রেমিক কবীর হয়ে মন কাড়েন নকুল আর রণবিজয়ও। ফ্ল্যাশব্যাকে ইন্দ্রনীলের তেমন কিছু করার ছিল না। তবে ফিরদৌস ওরফে ফিরুর ছোট্ট চরিত্রে সুফি কিংবা শিখার মা রাধা হিসেবে আয়েশা রাজা মিশ্রকে বেশ লাগে।           

 

 

 

তবে হ্যাঁ, ‘মেড ইন হেভেন’ থেকে ‘ব্যান্ড বাজা বরাত’, ‘ডেলহি বেলি’ থেকে ‘রকি অউর রানি’ কিংবা ‘আপ জয়সা কোই’— কারও আধ চামচ, কারও এক, কারও দুই কিংবা তিন চামচ দিব্যি ঢেলে ঘেঁটে নেওয়া গিয়েছে গল্পে। প্রথম চারটে পর্ব তাই কোথাও কোথাও খানিক খাপছাড়া ঠেকে। পঞ্চম পর্বে এসে সে ব্যাপারটা কাটিয়ে উঠে গতি পায় গল্প। ইদানীং দিল্লির অভিজাত জীবন কিংবা বাঙালি পরিবারের গল্প ওটিটি-দুনিয়ায় হট ফেভারিট। সে অঙ্কটাও মাথায় রাখতে ভোলেননি নির্মাতারা। তবে একই জিনিস বারবার দেখলে যে ক্লিশেও লাগে একটু!