শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানা বনাম রকগানের মেজাজ। তাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই টানটান এক গল্পে সাড়া ফেলেছিল ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’। অ্যামাজন প্রাইমে ২০২০-র সেই জনপ্রিয় সিরিজ তার পরের সিজন নিয়ে আসতে সময় নিল চার-চারটে বছর। তবে সবুরে মেওয়াও ফলেছে নিঃসন্দেহে। আনন্দ তিওয়ারির পরিচালনায় এবারের সিজনও গানের আমেজে, গল্পে ঠিক ততটাই মনকাড়া।
আগের সিজন শেষে পণ্ডিত রাধে মোহন রাঠোরের (নাসিরুদ্দিন শাহ) ঘরানার যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর নাতি রাধে (ঋত্বিক ভৌমিক)-র সঙ্গীত সম্রাট ঘোষিত হয় যোধপুরে। রাধে-তামান্নার (শ্রেয়া চৌধুরী) গড়ে তোলা ব্যান্ড বন্দিশ ব্যান্ডিটস ভেঙে যায়। ভেঙেচুরে যায় দু’জনের প্রেমের সম্পর্কটাও।
এবারের সিজন শুরু তার ঠিক তিন মাস পরে, পণ্ডিত রাধে মোহন রাঠোরের মৃত্যুতে। এরপরেই তাঁর ঘরানা ঘিরে শুরু হয়ে যায় টানাপোড়েন। ত্যাজ্যপুত্র দিগ্বিজয় রাঠোর (অতুল কুলকার্নি) নাকি বড় ছেলে রাজেন্দ্র (রাজেশ তৈলং)এবং পুত্রবধূ মোহিনীর (শিবা চাড্ডা) একমাত্র সন্তান রাধে— কার কাঁধে থাকবে ঘরানাকে এগিয়ে নিয়ে চলার ভার? তা নিয়ে বিস্তর গোলমালের মাঝেই একটি বইয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে রাঠোর পরিবারের অতীত এবং নানা লুকোনো সত্যি। শোরগোল পড়ে যায় চার দিকে। নিজেদের ঐতিহ্য, মর্যাদা থেকে গানের স্কুলের শিষ্য— সবই খোয়াতে থাকে পরিবার। এমনকী কাজ হারায় সারেঙ্গীবাদক কাকা দেবেন্দ্রও (প্রয়াত অমিত মিস্ত্রীর জায়গায় সৌরভ নায়ার)।
ইতিমধ্যে বদলেছে তামান্নার জীবনও। ‘অটোটিউন কুইন’-এর তকমা সরিয়ে সত্যি সত্যি ভাল গায়িকা হয়ে উঠতে চেয়ে সে ভর্তি হয়েছে কসৌলির রয়্যাল হিমালয়ান মিউজিক স্কুলে। যেখানে গানের শিক্ষিকা নন্দিনী (দিব্যা দত্ত)-র সঙ্গে তার ইগোর লড়াই জারি থাকার মাঝেই সিনিয়র ছাত্র আয়ানের (রোহন গুরবক্সানি) সাহচর্য ও বন্ধুত্ব গড়াতে থাকে সম্পর্কের দিকে।
রাধে-তামান্নার ফের দেখা হয় এক নামী ব্যান্ড প্রতিযোগিতার মঞ্চে। যেখানে গায়িকা হিসেবে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লড়াই তামান্নার। আর পরিবারের হারানো সম্মান খোয়াতে বদ্ধপরিকর রাধে এসেছে প্রায় পরিবারের অমতেই। একদিকে গান-জীবনের নানা ওঠাপড়া, অন্যদিকে হারানো প্রেমের টান কোথায় নিয়ে ফেলবে দু’জনকে? লক্ষ্যপূরণ হবে দু’জনেরই নাকি জোড়া লাগবে ভাঙা মন? সে সব নিয়েই এগিয়েছে এবারের সিজন।
গান নিয়েই গল্প। প্রথম সিজন চমকে দিয়েছিল তারই ঐশ্বর্যে। এবারের সিজনও নিরাশ করেনি মোটেই। পারিবারিক শত্রুতা, সম্পর্কের ভাঙাগড়া, ঐতিহ্য ও ঘরানার টানাপোড়েনের এত জটিলতার মাঝেও সেই সঙ্গীতময় প্রতিশ্রুতির জায়গাটা থেকে এক চুলও সরেনি। বলা বাহুল্য, সিরিজের পুরোটা জুড়েই আছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল বনাম রক কালচারের দাপুটে লড়াই এবং দুরন্ত সব গান।
ঋত্বিক কিংবা শ্রেয়া আগের বারের মতোই প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন। বলিষ্ঠ অভিনয়ে যথারীতি নজর কেড়েছেন অতুল, রাজেশ কিংবা শিবাও। বিশেষত পারিবারিক প্রথা ও নিষেধের বেড়া পেরিয়ে গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার দৃশ্যগুলোতে শিবা অনবদ্য। গানের দৃশ্যগুলোতে এ সিজনেও কাউকে মনে হয়নি স্রেফ লিপ মেলাচ্ছেন তাঁরা। রাধের ম্যানেজার অর্ঘ্যর চরিত্রে কুণাল রায় কাপুরকে যথারীতি ভাল লাগে। তবে এবারের সিজনের বাকি চরিত্রগুলোই বা কম কীসে! রাধের ব্যান্ডের লিড মাহী (পরেশ পাহুজা), তামান্নার সহপাঠী আয়ান (রোহন), শিক্ষিকা নন্দিনী (দিব্যা) প্রত্যেকেই যেন এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।
তবে হ্যাঁ, সিজনের আটটা এপিসোডের প্রত্যেকটাই বড্ড লম্বা। প্রায় এক ঘণ্টার একেকটা পর্ব। শেষ দুটো তার চেয়েও বেশি সময়ের। একটু ছোট বোধহয় করাই যেত। কিছু জায়গা বেশ চেনা ছকেই হাঁটে। বিশেষত ব্যান্ড প্রতিযোগিতার অংশগুলোয় অতটা ডিটেল না হলেও চলত। এই পর্বগুলো বড্ড বেশি ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ ধাঁচের হয়ে গিয়েছে।
তবে এটুকু খামতি পেরিয়ে যাওয়া যায় শুধু গানের টানেই। রাগ-নির্ভর ‘সাওন মোহে তরসায়’ কিংবা ‘হিচকি ২.০’-য় জ্যাজ ও লোকসঙ্গীতের মিলমিশ— এমন নানা স্বাদের গানই মোহিত করে রাখে গোটা সিজন জুড়ে। বন্দিশ কিংবা ব্যান্ড-রূপী ব্যান্ডিট, দুইই তার সারথি। আর নেপথ্যে শঙ্কর-এহসান-লয় এবং নিকিতা গান্ধী, সিদ্ধার্থ পণ্ডিত, স্বরূপ খান, সিদ্ধার্থ মহাদেবন, আশিস কউর, ওএএফএফ-র মতো একঝাঁক গুণী শিল্পী।
