“কালো, খাটো, কুৎসিত”— যাঁকে গ্রাম ‘ফেলনা’ বলত, সেই নওয়াজ আজ বিশ্বজোড়া মুখ! বলিউড তারকার মুখে শোষণ, বর্ণবিদ্বেষ, এবং জীবনের কঠোর সত্য তুলে ধরলেন 'গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর' খ্যাত এই জনপ্রিয় অভিনেতা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলিউডের শক্তিশালী এবং প্রতিভাবান অভিনেতাদের তালিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির নাম প্রথম সারিতেই। কিন্তু তাঁর এই যাত্রাপথ কোনও রঙিন গল্প নয়— বরং গা ছমছমে বঞ্চনা, বর্ণবিদ্বেষ, সামাজিক দমন-পীড়নের নির্মম প্রতিচ্ছবি।
“আমার চেহারা, আমার রং— এগুলোই ছিল আমার ‘অপরাধ’” বললেন নওয়াজ। সম্প্রতি, একান্ত সাক্ষাৎকারে নওয়াজ জানান, “আমার গায়ের রঙ, আমার উচ্চতা— সব কিছুই আমার বিরুদ্ধে গিয়েছিল। আমার গ্রামে আমায় খাটো, কালো, আর অসুন্দর বলে খোঁটা দেওয়া হতো। আমার পরিবারের বাকি পুরুষ সদস্যরা সব লম্বা, ফর্সা, সুপুরুষ। আমি ছিলাম ব্যতিক্রম— তাই ছোটবেলা থেকেই আমাকে কেউ গুরুত্ব দিত না।”
তিনি বলেন, “যখন কোনও বিয়ে বা অনুষ্ঠানে ডাকত, তখন সেই ডাকে থাকত লুকোনো অপমান। সমাজ যেন জানিয়ে দিত— তুমি আমাদের মতো নও। সেই হীনমন্যতা এতটাই গভীরে গেঁথে গিয়েছিল যে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।”
বলিউডে ঢুকেও পিছু ছাড়েনি বৈষম্য। নওয়াজ বলেন, “আজও বলিউডে কোনও শ্যামবর্ণের তারকা নেই। সব বড়, স্টাইলিশ চরিত্র ফর্সা নায়কদের জন্য। কালো গায়ের রঙ হলে তোর নাম গ্যাংস্টার, খুনি, গরীব লোক। আমার বেশিরভাগ চরিত্রই দেখুন— স্যুট-পরা নায়ক নই, আমি সর্বদা সস্তা জামাকাপড়ে ঘুরে বেড়ানো গ্যাংস্টার। মানে, 'কালো মানেই অন্ধকার'— এটা এখানে প্রমাণিত।”
আন্তর্জাতিক স্টেজে এখন অহরহ ওঠেন নওয়াজ, কিন্তু গ্রামে এখনও ‘তুচ্ছ’। সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য না? নওয়াজ বলেন, “আমার নিজের গ্রামের অনেকে এখনও বিশ্বাস করতে চায় না যে আমি ছবিতে অভিনয় করি! গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর যখন গ্রামের সিনেমা হলে চলছিল, আমার এক আত্মীয় ছবি দেখে বলেছিল, ‘এইটা নওয়াজ না, ওর মতো দেখতে কেউ।’ তারা আজও স্বীকার করে না আমি কিছু করেছি।”এই নির্মম বাস্তবতা নওয়াজের মতে, আমাদের সমাজের ‘স্টেটাস কু’-র’ প্রতীক। “তারা কখনও চায় না কেউ তাদের মধ্য থেকে উঠে আসুক। তাই আমি যতই খ্যাতি পাই, গ্রামে আমি এখনও সেই কালো, অযোগ্য নওয়াজ।”
সামাজিক ব্যর্থতা থেকে কান উৎসবের রেড কার্পেট— এক অভাবনীয় রূপান্তরের অন্যতম সাক্ষী নওয়াজ। নওয়াজ বলেন, “আমার কানে, প্যারিস বা লন্ডনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাওয়া যেন নিজের শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসা। আমি বুঝতেই পারি না এই মানুষটা আমি! ভারত আমাকে ছোট করলেও, আন্তর্জাতিক মিডিয়া আমায় বলে ‘হ্যান্ডসাম, এক্সপ্রেশন মাস্টার, আর্টিস্ট’। সাফল্য যেন আমার চেহারার সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে।”
একটা বদলে দেওয়া উক্তি, যা তিনি বুকে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে রাখেন, তা-ও জানালেন নওয়াজ। “আমি বিশ্বাস করি নেলসন ম্যান্ডেলার কথা— ‘আমাদের পৃথিবী রঙে, জাতিতে, লিঙ্গে বা ধর্মে বিভক্ত নয়। এই পৃথিবী বুদ্ধিমানদের ও মূর্খদের মধ্যে বিভক্ত। আর মূর্খরাই রঙ, জাতি, লিঙ্গে নিজেদের ভাঙে।’”
কথাশেষে “আমার জীবনের সব অপমানই আমার পাথেয়” মন্তব্য অভিনেতার। এই সাফল্যের পরেও অনেক পুরনো ক্ষত এখনও তাঁকে তাড়া করে। তবে নওয়াজ বলেন, “তারা ভেবেছিল আমি কিছু করতে পারব না— আজ সেই ‘অযোগ্য ছেলে’টাই কান, বার্লিন, লন্ডনের রেড কার্পেটে হাঁটে। আর এটা প্রমাণ করতেই আমার এতদিনের লড়াই।”
অন্য একটি সাক্ষাৎকারে বলিপাড়ায় বন্ধুত্ব নিয়েও মুখ খুলেছিলেন নওয়াজ। স্পষ্ট করে অভিনেতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, বলিউডের বন্ধুত্ব আর সম্পর্ক সেভাবে তৈরি হয় না কোনওদিন— সবই হয় সুবিধা-লাভের হিসেবনিকেশে। অভিনেতার কথায়, “আজ কেউ একজন তোমার বন্ধু, কাল অন্য কারও প্রয়োজন হলেই সে বদলে যাবে।” অভিনেতার মতে, এককথায় বলিউডে দারুণ অবিশ্বাস আর নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান।
তাঁর কথায়, “আমার আসল বন্ধুরা সবাই সেই সময়ের, যখন আমি বলিউডে নিজের পায়ের তলায় মাটি পেতে ব্যস্ত ছিলাম। আজকের বলিউডে এমন কোনও শক্তিশালী বন্ধুত্ব বা আনুগত্য নেই।” অভিনেতা স্পষ্ট করলেন, এই নিরাপত্তাহীনতা ও প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারণে বলিউডের অভিনেতাদের মধ্যে সম্পর্ক কখনও মজবুত হয় না, বরং প্রত্যেকে আলাদা করে নিজেদের ‘দল’ গঠন করে, একসঙ্গে থাকেন না।
