আজ তেসরা সেপ্টেম্বর ১০০-এ পা দিলেন উত্তমকুমার। তাঁর ঘাড় ঘুরিয়ে, সামান্য চোখ তুলে এক চিলতে হাসিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সিনেপর্দা। যার চলাফেরা, সংলাপ বলার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি- সবকিছুতেই ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি। মারা যাওয়ার পর এত বছর ধরেও তিনি এখনও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে। প্রায় একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন বাংলা ছবির অভিনয়ের ধারা। কিন্তু কার্টুনের বিষয় হিসেবে কতটা আকর্ষণীয় তিনি? কেন তাঁকে নিয়ে খুব বেশি কার্টুন আঁকা হয়নি? আজও যদি উত্তমকে নিয়ে কার্টুন-ক্যারিকেচার করা হয়, তা কি আদৌ জনপ্রিয় হবে?
গত কয়েক দশক ধরে কার্টুন ও কমিক্স চর্চায় ব্রত থেকেছেন দেবাশীষ দেব, উদয় দেব এবং সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি সংবাদপত্র, বইয়ে নিয়মিত কার্টুন অলঙ্করণ করে গিয়েছেন এঁরা। বাংলায় এইমুহূর্তে অন্যতম প্রধান এই তিন কার্টুনিস্ট তথা অলঙ্করণ শিল্পীর কাছে সেসব প্রশ্নের জবাবের সন্ধানে পৌঁছে গিয়েছিল আজকাল ডট ইন।

দেবাশীষ দেবের কথায়, “উত্তমকুমারকে নিয়ে একটি কার্টুন সিরিজ করেছিলেন প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণ ঘোষ। জলসা কিংবা উল্টোরথ পত্রিকায় তা ছেপে বেরিয়েছিল। ঠাকুমা থেকে গৃহবধূ, সেখান থেকে নাতনি - বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষদের সঙ্গে উত্তমকুমারকে নিয়ে একচোট মজা করে এই উত্তম-সিরিজ বানিয়েছিলেন তিনি। আবার পাড়ার রকবাজ ছেলের পিঠেও চেপে বসিয়েছিলেন 'গুরু-কে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছে উত্তমকুমার কীভাবে, কতভাবে পৌঁছে গিয়েছিলেন সেটাই রঙ্গব্যঙ্গ করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন রেবতী ভূষণ।

আমি নিজেই উত্তমকুমার নিয়ে একটি কার্টুন করেছিলাম। মানে ঠিক ব্যাঙ্গাত্মক ক্যারিকেচার নয়। এঁকেছিলাম, টালিগঞ্জে উত্তমের মূর্তির সামনে দু'টি মেয়ে আলোচনা করছে –‘ইস আর একজন উত্তমকুমার কেন আমরা পেলাম না?’ এই যে বিভিন্ন প্রজন্মে উত্তমকুমারকে নিয়ে যে একটা হৈহৈ, সেটা কার্টুনিস্ট হিসেবে আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয়। ১৯৬৯ সালে চণ্ডী লাহিড়ী তো সত্যজিৎ-উত্তমের ওই সমস্যা নিয়ে কার্টুনও করেছিলেন, বেশ তীর্যকভাবেই। যেকোনও মানুষকে নিয়েই কার্টুন করা যায়। বিদেশে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে দেদার কার্টুন আঁকা হয়, সেই ট্রেন্ড এখানে নেই। তবে কার্টুনের বিষয় হিসেবে উত্তমকুমার আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। তবে উত্তমকুমারকে নিয়ে কেন বেশি কার্টুন আঁকা হয়নি, এটা ভাল প্রশ্ন। হ্যাঁ... করা যেতেই পারত। করলেই হত...আসলে উত্তমকুমার এমন এমন একটা স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাই হয়তো...”

উদয় দেব তাঁর নিজস্ব ছন্দে বলে উঠলেন, “বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণ ঘোষের করা উত্তম-সিরিজ তো বিখ্যাত। খুব মজার। আমি নিজেও একটা কার্টুন করেছিলাম উত্তমকুমারকে নিয়ে। সেই সময়ে কথা উঠেছিল, টালিগঞ্জের মোড়ে উত্তমকুমারের ওই বিখ্যাত মূর্তি স্থানান্তরিত করার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিষয়টা প্রকাশ্যে আসামাত্রই একটা হৈ-হট্টগোল বাঁধে। ওই ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটা কার্টুন এঁকেছিলাম, মানুষ বেশ গ্রহণ করেছিল। যাক সে কথা....এবার আসি, কার্টুনিস্টদের চোখে কতটা আকর্ষণীয় উত্তমকুমার? দেখুন, যে কোনও মানুষের ক্যারিকেচার করতে গেলে সেই চরিত্রটির অন্তত একটি ফিচার থাকা দরকার। আর এদিকে উত্তমকুমারের মুখ এতটাই সাজানো গোছানো... তাই ঝুঁকিও বেশি। একটু বুঝিয়ে বলি, উত্তমকুমারের হাসির ছবিতে দেখা যায় ওঁর সেই গজ দাঁত দু’টো। সেই গজ দাঁত দু’টো যদি সাবধানে, সূক্ষ্মভাবে আঁকা না যায় তাহলে উত্তমকুমার নিমেষে হয়ে যাবেন ড্রাকুলা! মানে উত্তমকুমারকে নিয়ে দু'টো কার্টুন একেঁছিলাম। একটিতে সেই গজ দাঁত সব আঁকতে মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। আবার উত্তমের সেই এলভিস স্টাইলের চুল...সেখানেও একটু বাড়াবাড়ি হলে ঘেঁটে যাবে পুরো ব্যাপারটা। তাই একটা টেনশন তো কাজ করছিলই...শেষমেশ কাজের ডেডলাইনের চাপ আমাকে আঁকিয়ে নিয়েছিল উত্তম-কার্টুন!

আর একটা কথা বলি, এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত। ভীষণ কম উত্তমকুমারের কার্টুন-ক্যারিকেচার দেখেছি আমি যেটা আমাকে কষ্ট করে চিনতে হয়নি উত্তমকুমারকে! আমি আমার প্রজন্মের কথাও বলছি, আগের প্রজন্মের কথাও বলছি। আমার কথা হচ্ছে, আপনি গান্ধী আঁকুন কিংবা উত্তম এবং যে ফ্রেমেই আঁকুন তাঁকে এক ঝলক দেখেই বুঝতে পারা উচিত তিনি কে। এই বিষয়টি আমার উত্তমকুমারের হাতে গোনা দু’একটি কার্টুন ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রে মনে হয়নি! কার্টুনের নীচে নাম দেখে বুঝতে হয়েছে তিনি উত্তম। শেষ করি নিজের একটা উত্তম-কার্টুন আঁকার করুণ অভিজ্ঞতা দিয়ে। শ্রীজাতর একটি লেখার সঙ্গে আমাকে উত্তমকুমারের কার্টুন আঁকতে হয়েছিল। তা কিছুতেই পারছি না। ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল। সেই চরিত্রটি কখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে যাচ্ছে কখনও বা উত্তমকুমারের ছোট ভাই! শেষমেশ, সেই ডেডলাইনের চাপে, ভয়ে উৎরে গিয়েছিলাম। তাই থ্যাংক য়ু, ডেডলাইন।” হাসতে হাসতে বলে উঠলেন উদয়। কথাশেষে তাঁর সংযোজন, “আর উত্তমকুমারের যে জনপ্রিয়তা, সম্মান তাতে ওঁকে নিয়ে কার্টুন করাটা খুবই ঝুঁকির। শচীন তেণ্ডুলকরকে নিয়ে যেমন খুব, খুব কম কার্টুন দেখা যায়। নেগেটিভ কার্টুন তো আরও কম। কেন? আসলে, আম জনতার সিংহভাগ যদি কাউকে বিপুল সম্মান করে, তাঁকে নিয়ে ক্যারিকেচার করাটা খুব মুশকিল, তাই।”
সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা যখন কোনও ব্যক্তির ক্যারিক্যাচার বানাই, কার্টুন আঁকি তখন তো সেই মানুষের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে নিয়ে তাঁর ক্যারেক্টার বিল্ড-আপ করি, সেখানে উত্তমকুমার একাধিক প্রজন্ম নির্বিশেষে স্টাইল আইকন। তাঁর হাঁটার স্টাইল, হাসি, কথা বলা, চুলের স্টাইল, মুখে সিগারেট ঝুলিয়ে কথা বলার ধরন এসব কিন্তু উনি নিজে তৈরি করেছিলেন। হলিউডের ছবি দেখতেন খুবই, তাই সেখানকার আদবকায়দা সঙ্গে বাঙালিয়ানা মিশিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য একটি স্টাইল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। যা দেখে কখনওই মনে হতো না আরোপিত। তাই উত্তম-কার্টুনের ক্ষেত্রে একাধিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা দিয়ে তাঁর কার্টুন অনায়াসে আঁকা যায়। এবং বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ধরনের কার্টুন করা যায় ওঁর। এটা কিন্তু আর পাঁচজন তারকার ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। সবার বড়জোর একটি কী দু'টি এরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। আর একটা কথা বলব, কার্টুনিস্ট হিসেবে আমাদের কাজ তো ব্যাঙ্গের মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ করা...সেই প্রসঙ্গে বলছি, কৌতুকাভিনেতা হিসেবেও উত্তমকুমার কিন্তু অসাধারণ ছিলেন। কমেডি-দৃশ্যে ওঁর ভুরু তোলা, ঠোঁটের বিশেষ ভঙ্গি, গালের মাংসপেশি নিয়ে খেলা করা এসবও ভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্য নিয়েও ক্যারেক্টারাইজ করে নানান মুডের কার্টুন তৈরি করা যায়। এবং সেসব ঠিকঠাক উৎরে দিতে পারলে যে তা বিভিন্ন প্রজন্মের পাঠকেরা উপভোগ করবে, তা জোর দিয়ে বলতে পারি।”
