আজকাল ওয়েবডেস্ক: ঘোষণা করেছিলেন আগেই। বুধবার সকাল ৯টা ৩১ মিনিট (ভারতীয় সময়) থেকে কার্যকর হয়ে গেল ভারতের উপর আরোপিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় ভারতের রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খেল। ভারতের আমেরিকায় রপ্তানি করা পণ্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (যার বার্ষিক মূল্য প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার) এ বার ৫০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়ল। এতদিন পর্যন্ত যা ছিল ২৫ শতাংশ।
কেন এই সিদ্ধান্ত নিল ট্রাম্প প্রশাসন?
ওয়াশিংটনের দাবি, ভারত এখনও রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি করছে। তেল কিনে রাশিয়ার হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে ইউক্রেনে মানুষ নিধন করার জন্য। সেই কারণেই এই বাড়তি শুল্ক। মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, বুধবার থেকে আমেরিকায় প্রবেশ করা ভারতীয় সমস্ত রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম কার্যকর হবে।
ভারতের ক্ষতির অঙ্ক কতটা?
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)-এর মতে, আমেরিকায় ভারতের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৬০.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যে এখন দ্বিগুণ শুল্ক প্রদান করতে হবে। সরকারের হিসেবে যদিও ক্ষতির অঙ্ক কিছুটা কম। মাত্র ৪৮.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে এই ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এত ভারী শুল্কের ফলে ভারতের রপ্তানি শিল্প অচল হয়ে যেতে পারে। কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন যে নতুন শুল্কের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পরিবহন বাণিজ্যিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। যার ফলে চাকরি হ্রাস পাবে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলি
টেক্সটাইল ও পোশাক: ২০২৫ অর্থবর্ষে আমেরিকায় ভারতের টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানি ছিল ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র পোশাকই আমেরিকায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়। রপ্তানিতে আমেরিকায় ৩৫ শতাংশ ছিল ভারতীয় পোশাকের দখলে। শুল্ক ১৩.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৩.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে ভারতীয় পণ্যের দাম বাড়বে। এর ফলে তিরুপুর, নয়ডা-গুরুগ্রাম, বেঙ্গালুরু, লুধিয়ানা এবং জয়পুরের ক্লাস্টারগুলিতে প্রভাব পড়বে। এই জায়গায় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো এবং CAFTA-DR দেশগুলি ভারতীয় সরবরাহকারীদের প্রতিস্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রত্ন ও গয়না: এই খাতে ভারতের বৈশ্বিক রপ্তানির ৪০ শতাংশ ছিল আমেরিকায়। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি। শুল্ক ২.১ শতাংশ থেকে ৫২.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে সুরাট, মুম্বই এবং জয়পুরে চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। এই জায়গাগুলিতে এই শিল্প কাটিং, পলিশিং এবং উৎপাদনে লক্ষ লক্ষ লোককে নিয়োগ করে।
চিংড়ি: ২০২৫ অর্থবর্ষে ভারত আমেরিকায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চিংড়ি রপ্তানি করেছে। যা মোট চিংড়ি রপ্তানির ৩২.৪ শতাংশ। চাষ করা চিংড়ি, বিশেষ করে খোসা ছাড়ানো, তৈরি, রান্না করা চিংড়ির জন্য আমেরিকা ভারতের শীর্ষ বাজার।

কার্পেট ও হস্তশিল্প: ২০২৫ অর্থবর্ষে আমেরিকায় ভারতের রপ্তানি ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় কার্পেট রপ্তানিতে অংশিদারি ৫৮.৬ শতাংশ। শুল্ক ২.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫২.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে ভাদোহি, মির্জাপুর এবং শ্রীনগরের কারিগরদের জীবিকাকে হুমকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, তুরস্ক, পাকিস্তান, নেপাল এবং চীন লাভবান হচ্ছে। একই অর্থবর্ষে ভারতের হস্তশিল্প রপ্তানি ছিল ১.৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতীয় রপ্তানিতে ওয়াশিংটনের ৪০ শতাংশ অংশ রয়েছে। এর ফলে যোধপুর, জয়পুর, মোরাদাবাদ এবং সাহারানপুর জুড়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, তুরস্ক এবং মেক্সিকো এই শূন্যতা পূরণ করবে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
চামড়া ও জুতো: ভারতের চামড়াজাত পণ্য এবং জুতো রপ্তানির পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার। এখন এটি সম্পূর্ণ ৫০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়বে। যা ভিয়েতনাম, চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকোর কাছে তাদের জমি হারাবে। আগ্রা, কানপুর ও তামিলনাড়ুর আম্বুর-রানিপেট শিল্পাঞ্চলের টিকে থাকা কঠিন হবে।
কৃষিজ পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাবার: বাসমতী চাল, চা, মশলা মিলিয়ে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে চাপে পড়বে ভারত। পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এই শূন্যস্থাম পূরণ করবে।
কারা রক্ষা পেল?
ভারতের প্রায় ৩০ শতাংশ রপ্তানি, অর্থাৎ ২৭.৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, আপাতত শুল্কমুক্ত থাকছে। এর মধ্যে প্রধান হল ঔষধ ও API পণ্য, যা আমেরিকার বাজারে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান বজায় রাখবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি সামগ্রী, যেমন স্মার্টফোন, চিপস, রাউটিং যন্ত্রাংশ ইত্যাদিও বাদ পড়েছে এই শুল্ক তালিকা থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক আরোপের ফলে ভারতের রপ্তানি ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। বিপন্ন হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা। একদিকে কর্মসংস্থান, অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি দুইয়ের ওপরেই ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে চলেছে এই মার্কিন শুল্কনীতি। প্রশ্ন একটাই, ভারতের রপ্তানি শিল্প কি নতুন বাজার খুঁজে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে, নাকি বড়সড় অর্থনৈতিক ঝড়ের মুখোমুখি হতে চলেছে দেশ?
