আজকাল ওয়েবডেস্ক: তিন বছর তিন মাস আঠারো দিন পর অবশেষে মুক্তি পেলেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জামিনের খবরে নতুন করে চর্চায় উঠেছে শান্তিনিকেতনের সেই বহুল আলোচিত বাড়ি ‘অপা’। নামের মধ্যেই জড়িয়ে রয়েছে বিতর্ক। অর্পিতা ও পার্থ, দুই নামের সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছিল এই বাড়ির পরিচিতি। একসময় কৌতূহলী মানুষে ভরে থাকত ফুলডাঙার এই এলাকাটি। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই মাসে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় পার্থবাবুর গ্রেপ্তারের পর থেকেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ‘অপা’।
এই তিন বছরে বাড়িটি যেমন নিস্তব্ধ ছিল, তেমনই নিস্তব্ধ থেকেছেন ওই বাড়ির পরিচারক দম্পতি - ঝর্ণা ও নিখিল দাস। ২০২২ সালের আগস্টে ইডি অভিযানের পর যখন অর্পিতা মুখোপাধ্যায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঘিরে সারা রাজ্যে তোলপাড়, তখনই এক সংবাদে ধরা পড়েছিল তাদের জীবনযুদ্ধের কাহিনি। মালিক জেলে, সংসারে অভাব, অথচ দায়িত্বে একটুও ফাঁক রাখেননি তাঁরা। প্রতিদিন বাড়ির আলো জ্বেলে রাখা, বাগান পরিষ্কার, ঘরের ধুলো মুছে রাখা- যেন বাড়িটা ফেলে রাখা মনে না হয়।
তাঁদের কথায়, “মালিকরা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন, তাই না আসা পর্যন্ত ছেড়ে যাইনি।” আর সেই অটল সততাই যেন এখন সবচেয়ে বড় পরিচয় ‘অপা’র।

তবে তিন বছরের এই দীর্ঘ সময় সহজ ছিল না। আক্ষেপ ও অভিমানের সুরে ঝর্ণা জানান, “তিন বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি। লাইটের কানেকশন কেটে দিয়েছিল, খেতে পাচ্ছি কী না কেউ দেখেনি। কিন্তু আমরা ভেবেছি, এটা দাদাবাবুর বাড়ি, যতদিন বাঁচি ততদিন পাহারা দেব।” গাছ থেকে পড়ে গিয়ে নিখিলের কোমরে যন্ত্রণা, কাজের অক্ষমতা আজও রয়ে গিয়েছে। তারপরও দিনমজুরিতে যে সামান্য আয়, তাতেই কোনওরকমে সংসার চলে।
২০২২ সালের আগস্টে তাঁরা বলেছিলেন, "প্রয়োজনে আধপেটা খেয়েও থাকব, এই বাড়ি ছেড়ে যাব না।" তিন বছর পরও সেই কথা যেন আজও সত্যি। দাদাবাবু জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, এই খবর পাওয়া মাত্রই ঝর্ণার চোখে জল। কণ্ঠে আবেগ মিশে বলে ওঠেন, “দাদাবাবু জামিন পেয়েছেন শুনে খুব আনন্দ লাগছে। তিন বছর আমরা যে কীভাবে কাটিয়েছি, একমাত্র ঈশ্বর জানেন। আশা করি, এবার হয়তো আমাদের সুদিন ফিরবে।”
'অপা' বাড়ি এখনও আগের মতোই নিস্তব্ধ, তবে নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন একরাশ আশার আলো। ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাইরের বাগান সাজানো - সব কিছুই ঠিকঠাক রাখা হয়েছে। স্থানীয়দের কথায়, পরিচারক দম্পতির এই নিষ্ঠা ও সততা সত্যিই বিস্ময়কর। কেউ আসেনি, কেউ দেখেনি, তবু দায়িত্ববোধে টিকে থেকেছেন তাঁরা।

তিন বছর আগে যাঁদের ভিড়ে মুখ দেখা যাচ্ছিল না, আজ সেখানে কেবল বাতাসের হালকা শব্দ। অথচ সেই শূন্যতার মধ্যেই বেঁচে আছে এক বিশ্বস্ত দম্পতির অটল বিশ্বাস- “দাদাবাবু একদিন ফিরবেন।”
পার্থবাবুর জামিন এখন শুধু এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের মোড় নয়, বরং শান্তিনিকেতনের এই ‘অপা’ বাড়ির ইতিহাসে যেন এক মানবিক অধ্যায়ের পুনর্জাগরণ। কারণ, তিন বছর অন্ধকারের মধ্যেও আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন ঝর্ণা ও নিখিল - সততার সেই আলোই আজ ‘অপা’কে জীবন্ত রেখেছে।
