আজকাল ওয়েবডেস্ক: লাভপুরের মানুষের কাছে তিনি শুধু একজন চিকিৎসক নন, তিনি আপনজন। সম্মান করে ও ভালোবেসে যাঁকে সবাই বলেন বিশু ডাক্তার। আসল নাম সুকুমার চন্দ্র। বয়স ৯৮ বছর। সারাজীবন মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে কাটিয়েছেন। অসংখ্য মৃত্যু দেখেছেন, অগণিত ডেথ সার্টিফিকেট লিখেছেন। কিন্তু শুক্রবার সেই লড়াই যেন কিছুটা ধাক্কা খেল। জীবনে এই প্রথম কলম ধরেই কেঁপে উঠল তাঁর হাত—লিখতে হচ্ছিল নিজের স্ত্রীর ডেথ সার্টিফিকেট।

স্ত্রীর নাম রাধা চন্দ্র। বার্ধক্যজনিত কারণে গত চার মাস ধরে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। স্ত্রীর অসুস্থতার মাঝেও শেষ দিন পর্যন্ত রোগী দেখা বন্ধ রাখেননি বিশু ডাক্তার। আগের দিনও কুরুন্নাহার থেকে দুর্যোধন বাগদি, লাভপুরের স্বপন মন্ডল, মুর্শিদাবাদের নিখিল ঠাকুরের মতো বহু মানুষ তাঁর কাছে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। তাঁরা জানতেন, ঘরে অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে আছেন, তবু ডাক্তারবাবু ছিলেন আগের মতোই স্থির ও অবিচল।

সুকুমার চন্দ্র আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। পড়াশোনা শেষে উত্তরপ্রদেশের কাটনি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির হাসপাতালে লোভনীয় বেতনের সরকারি চাকরির সুযোগ পান। কিন্তু সেই চাকরিতে তিনি যোগ দেননি। কারণ, সেই সময় লাভপুর ও সংলগ্ন গ্রামগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। অসুস্থ মানুষকে শহরে ছুটতে হত, অনেক ক্ষেত্রে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটত।

এই বাস্তবতা ভাবিয়ে তুলেছিল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিশু ডাক্তারের বাবা শরৎচন্দ্র চন্দ্র ছিলেন তারাশঙ্করের বাল্যবন্ধু। সেই সূত্রেই বিশুকে ডেকে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, গ্রাম ছেড়ে চাকরি করতে যাওয়া চলবে না। গ্রামের মানুষকে দেখার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। সেই নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেননি বিশু ডাক্তার। এক টাকার ভিজিটে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। আজও কোনো নির্দিষ্ট ভিজিট নেই। যে যা হাতে তুলে দেন, তাই নেন। বহু ক্ষেত্রে বিনা পয়সাতেও চিকিৎসা করেছেন।

জীবনের পথে একের পর এক আঘাত এসেছে। বছর দুয়েক আগে চিকিৎসক ছেলে সৌমিত্রকে হারিয়েছেন। সেই শোকের দিনেও, এমনকি ছেলের শ্রাদ্ধের দিনেও রোগী দেখা বন্ধ করেননি তিনি। তাঁর আজীবন মানবসেবার স্বীকৃতি হিসেবে রাজ্য সরকার ২০২০ সালে তাঁকে জীবনকৃতি পুরস্কার দেয়।
কিন্তু গত শুক্রবার সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এল ব্যক্তিগত শোক। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গিয়ে কলম কেঁপে যাচ্ছিল। বিশুডাক্তার বলেন, এই দিনটা যে তাঁকে দেখতে হবে, কখনও ভাবেননি। মেয়ে সুছন্দ বলেন, গ্রামের মানুষের চিকিৎসার কাজে তাঁর মা ছিলেন বাবার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
স্থানীয় নাট্যকর্মী উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ও কেদারনাথ আচার্য জানান, বিশু ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রী লাভপুরের মানুষের আত্মীয়ের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। তাই এই বিয়োগ গোটা এলাকার আত্মীয় বিয়োগের সমান। তারাশঙ্করের ভ্রাতুষ্পুত্র বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিশু ডাক্তার ছিলেন তারাশঙ্করের পুত্রসম। তাঁর নির্দেশেই সরকারি চাকরি ছেড়ে আজীবন গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এবং আজও সেই পথেই অবিচল আছেন।