আজকাল ওয়েবডেস্ক: শীতের আমেজ পড়তেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাজুড়ে ফিরে আসে এক চিরাচরিত দৃশ্য। গ্রামের পর গ্রাম, পাড়া থেকে উঠোন, সব জায়গাতেই শুরু হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী গয়না বড়ি তৈরির ব্যস্ততা। সবং, পিংলা, ডেবরা, নারায়ণগড়, বেলদা-সহ জেলার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে এখন রোদে শুকোচ্ছে সাদা রঙের নকশা বড়ি। শীতের রোদে সাজানো এই বড়িগুলি যেন শুধুই খাদ্য প্রস্তুতি নয়, বরং পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গয়না বড়ি তৈরির প্রথা বহু পুরনো। শীতের শুরুতেই মুগ ডাল বা কলাই ডাল ভিজিয়ে, বেটে, তার সঙ্গে মশলা মিশিয়ে নানা নকশায় বড়ি তৈরি করা হয়। পরে সেগুলি রোদে শুকিয়ে সারা শীতের রান্নার জন্য মজুত করে রাখা হয়। উঠোন, ছাদ কিংবা খোলা বারান্দা যেখানে রোদ পৌঁছয়, সেখানেই পাত পেতে সারি সারি বড়ি সাজানো থাকে। সেই দৃশ্যেই যেন ফুটে ওঠে গ্রামবাংলার শীতকালীন জীবনযাত্রার ছবি।

এই কাজে শুধু গৃহবধূরাই নন, বাড়ির কিশোরী স্কুলছাত্রী থেকে কলেজ পড়ুয়া তরুণীরাও মায়েদের পাশে বসে বড়ি বানাতে হাত লাগাচ্ছেন। একদিকে যেমন শেখা হচ্ছে ঘরোয়া রান্নার কৌশল, তেমনই পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারও গড়ে উঠছে। অনেকেই জানান, বড়ি বানানোর এই সময়টুকুই পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বসার সুযোগ এনে দেয়। আলোচনায় উঠে আসে সেই সময় থেকে এই সময়ের বড়ি বানানোর নানা ইতিহাস। 

গয়না বড়ি গোটা রাজ্য জুড়েই পরিচিত। পশ্চিম মেদিনীপুরের এই 'ঘরোয়া' জিনিসের সুখ্যাতি জেলার সীমানা ছাড়িয়ে বহুদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার নানা প্রান্তে। জানা যায়, মেদিনীপুরের এই বিশেষ বড়ি খেতে ভালোবাসতেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মতো বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মতো মানুষের পছন্দ হওয়াই প্রমাণ করে এই গয়না বড়ির স্বাদ ও গুণমান। আজ আধুনিক জীবনযাত্রায় বাজারজাত খাবারের প্রভাব বেড়েছে, তবুও পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রামবাংলায় শীত এলেই গয়না বড়ি বানানোর রীতি এখনও অটুট। মাছের ঝোল হোক বা সবজি রান্না, গয়না বড়ি ছাড়া শীতের খাওয়া অসম্পূর্ণ বলেই মনে করেন বহু মানুষ। শীতের রোদে শুকোতে থাকা এই বড়িগুলিই তাই পশ্চিম মেদিনীপুরের রান্নাঘর ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে।