আজকাল ওয়েবডেস্ক: গাজায় চলমান যুদ্ধের প্রায় দুই বছরে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিশ্বমঞ্চে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে প্রচারিত হয়েছে। এই সংখ্যা হাসপাতাল ও মর্গে পৌঁছনো দেহের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার দুই গবেষকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন — ‘Skewering History: The Odious Politics of Counting Gaza’s Dead’ — দাবি করছে যে, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এই হিসেবের দশ গুণ বেশি। তাদের মতে, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৬.৮ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছেন, যা যুদ্ধ শুরুর আগে গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর মধ্যে আনুমানিক ৩.৮ লক্ষ শিশু।
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রক হিসেবকে আন্তর্জাতিক মহল সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য বলেই মেনে নেয়, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলি আসলে ‘রক্ষণশীল’ পরিসংখ্যান। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হাজার হাজার দেহ এখনো উদ্ধার হয়নি। অনাহার ও ওষুধের অভাবে মৃত্যুর হিসেবও এতে ধরা হয় না। ইরাক, আফগানিস্তান, কঙ্গো প্রভৃতি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ব্যবহৃত স্বীকৃত ‘সংঘাতকালীন অতিরিক্ত মৃত্যু’ (excess mortality) পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখা গেছে, প্রত্যক্ষ মৃত্যুর তুলনায় পরোক্ষ মৃত্যু বহুগুণ বেশি। সেই হিসেবেই গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা সহজেই অর্ধলক্ষাধিক ছাড়িয়ে অর্ধকোটি থেকে সাত লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে গবেষকরা দাবি করেছেন।
যখন এই ভয়াবহ সংখ্যা বিশ্বকে নাড়া দেওয়ার কথা, তখনও আরব শাসকরা কেবল বক্তৃতা ও বিবৃতির রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ৯ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান দোহায় হামলা চালিয়ে হামাস নেতাদের টার্গেট করে। কাতার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে, সৌদি আরব একে অপরাধ ঘোষণা করে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি একে বিশ্বাসঘাতকতা বলে চিহ্নিত করে। জরুরি বৈঠক, তীব্র নিন্দা, সংহতির ভাষণ—সবই হয়েছে। কিন্তু কোনও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, কিংবা বাণিজ্যিক অবরোধ কিছুই হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, আরব ঐক্যের এই প্রদর্শন আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক নাটক।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন — “হামাস নেতারা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন, তারা নিরাপদ নয়।” এই বক্তব্য তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও-র উপস্থিতিতেই দিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে তিনি এক নতুন মতবাদ প্রচার করলেন — ইজরায়েল যে কোনও দেশকে, যে কোনও সময়ে, “আত্মরক্ষার নামে” বোমা মারার অধিকার রাখে। এটি আর গোপন যুদ্ধ নয়, বরং প্রকাশ্য শক্তি-প্রদর্শন। মার্কিন আশ্বাসকে অকার্যকর প্রমাণ করে ইজরায়েল দেখিয়ে দিল যে আরব রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব আসলে অপ্রাসঙ্গিক।
ইতিমধ্যেই ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম-সহ একাধিক পশ্চিমা দেশ আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইজরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক হ্রাস ও কিছু ইজরায়েলি নেতার উপর নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপও মূলত প্রতীকী। ইজরায়েলের নীতি বা হামলার গতি থামেনি। বরং পশ্চিম তীরে দখলদারি বাড়ছে, গাজার ধ্বংসযজ্ঞ তীব্র হচ্ছে।
গাজায় মৃত্যুর প্রকৃত পরিমাণ, আরব রাষ্ট্রগুলির প্রতিক্রিয়ার ভণ্ডামি এবং ইজরায়েলের সীমাহীন সামরিক আগ্রাসনের নীতি — এই তিনটি মিলে স্পষ্ট করছে যে: গাজা আজ কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ভাঙন। তথাকথিত ‘rules-based order’ বা নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনেতারা নিন্দা, সমবেদনা ও প্রতীকী স্বীকৃতির আড়ালে আসলে নির্বিকার দর্শকের ভূমিকাই পালন করছেন।
গাজা গণহত্যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মুখোশের আড়ালে কেবল কথার খেলা। যখন লক্ষাধিক মানুষ, তার মধ্যে কয়েক লক্ষ শিশু, মাটিচাপা পড়ে ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ে হারিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্বনেতারা দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু করেননি।
