চার নম্বর সিজনে এসে কি জমি হারাচ্ছে ‘পঞ্চায়েত’? নাকি অটুট রইল তার টান? সিরিজ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।
 
 চেনা সুবাস একটু কি ফিকে? ‘ফুলেরা’র আকাশ-বাতাসে যে শুধুই ভোটের ডামাডোল আর রাজনীতির মারপ্যাঁচ! এক বছর পেরিয়ে চার নম্বর সিজন পর্দায় হাজির হতেই যথারীতি ফের লোকের মুখে মুখে ফিরছে ‘পঞ্চায়েত’। এবং সেই সঙ্গেই জলে-স্থলে-চায়ের স্টলে, সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডে ঘুরেফিরে আসছে এই প্রশ্নগুলো।
 
 গত সিজনেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পঞ্চায়েত ভোটের অঙ্ক কষা। প্রধানজি (রঘুবীর যাদব) এবং মঞ্জু দেবীর (নীনা গুপ্তা) জুটিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিল বিরোধী গোষ্ঠীর মুখ ‘বনরাক্ষস’ ভূষণ (দুর্গেশ কুমার) এবং তার স্ত্রী ক্রান্তি দেবী (সুনীতা রাজওয়ার)। এবার তাঁরা ভোটের ময়দানে সম্মুখ সমরে। যেনতেনপ্রকারেণ ফুলেরার আমজনতাকে তুষ্ট করে ভোট টানতে বদ্ধপরিকর। সেই মহারণে প্রধানজী আর মঞ্জুদেবীর পাশে বরাবরের মতোই হাজির মেয়ে রিঙ্কি (সনভিকা), ‘সচিবজি’ অভিষেক ত্রিপাঠী (জিতেন্দ্র কুমার), সহ-সচিব বিকাশ (চন্দন রায়) এবং প্রহ্লাদ’চা (ফয়জল মালিক)। আর ভূষণের পাশে তার পরম ভক্ত বিনোদ (অশোক পাঠক)। যাকে নিজেদের দলে টানতে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রধানজী আর তার দলবল। এসবের মধ্যেই প্রধানজীর গুলি লাগার ঘটনার জের টেনে গদি হারায় বিধায়কজি (পঙ্কজ ঝা)। সেই পদে বসার প্রস্তাব যায় প্রহ্লাদের কাছে। কিন্তু সে কি রাজি হবে এই প্রস্তাবে? ভোটের বাজিতেই বা শেষ হাসি হাসবে কারা? 
আরও পড়ুন: সার্জারিতে বদলেছিল মুখের মানচিত্র, নিজের রূপ ফিরে পেতে ফের কারসাজি! এখন কেমন ঠোঁট পেলেন উরফি?
 
 অ্যামাজন প্রাইমের জনপ্রিয় সিরিজের এবারের সিজন ঘুরপাক খেয়েছে তারই অলিতে গলিতে। আর টুকরো টুকরো মুহূর্তে ভোটের কাঁটার মাঝে ফুলের মতোই একটু একটু করে ফুটে উঠেছে সচিবজি আর রিঙ্কির মিঠে প্রেমের গল্প।    
কেউ বলছেন, এত মিষ্টি একটা সিরিজ, এত সহজ-সরল এক কাহিনিতে এভাবে ভোটের দামামা বাজিয়ে দেওয়া কি খুব জরুরি ছিল? কেনই বা ফুলের মতোই সুবাস ছড়ানো ফুলেরার নরমসরম, শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে টেনে আনা হচ্ছে রাজনীতির পাঁকে? পাল্টা কেউ আবার বলছেন-- গল্প যখন গ্রাম পঞ্চায়েতকে ঘিরে, তাতে রাজনীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, মারামারি এসে পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক, বাস্তব ঘেঁষা। ফুলেরার নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন, ভালবাসায় ঘেরা সম্পর্কের গল্পগুলোই বরং খানিক কল্পজগতে বিচরণ করত।
গল্পে ভোটের তরজা আর তাকে ঘিরে দর্শকমহলে এমন জোরদার তর্ক-চর্চার মধ্যেও তবু সিরিজ জুড়ে যেন মায়ার পশম বোনা থাকে। তাতে হাত দেবার বড্ড আরাম। খাতায়-কলমে ভিলেন চরিত্রগুলোকে তাই যেন ঠিক ঘেন্না করে ওঠা যায় না। এই বিনোদের কথাই ধরা যাক। রাজনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যিখানে থেকেও যার সাদা মনে কাদার দাগ লাগেনা একটুও। বিপক্ষ দলের হয়েও তাই সে অক্লেশে প্রধানজীর দেওয়া লাড্ডু খেতে পারে। আবার দলবদলের প্রস্তাবে সটান বলে দিতে পারে, ‘হাম গরিব হ্যায়, গদ্দার নেহী’। ভোটের ফলাফলের পর চোখের জলে, গলার কাছে দলা পাকানোয় বিনোদকে তাই বড্ড চেনা মানুষ মনে হয়। কিংবা ভূষণ আর ক্রান্তিদেবী। ভোট ঘিরে এত ঝুটঝামেলা, এত অশান্তিও তাদের দাম্পত্যে ছায়া ফেলতে পারেনা একচিলতে। ভাল থেকে মন্দে শক্ত করে একে-অন্যের হাত ধরে থাকে দু’জনেই। এমন ভিলেনদের কি একটু ভাল না বেসে থাকা যায়!
 
 আর সচিবজি? সরকারি চেয়ারে বসেও, চাকরিতে সমস্যা বা আগামীর তোয়াক্কা না করে স্রেফ সম্পর্কের খাতিরে যে প্রধানজি আর মঞ্জু দেবীর ঢাল হয়ে দাঁড়ায় প্রতিটা মুহূর্তে, তাকে তো দর্শক মনের মধ্যে জায়গা দেবেই। রিঙ্কির সঙ্গে তার না বলা প্রেম এতদিনে একটু একটু করে ভাষা হয়ে ফুটছে। দু’জনের সম্পর্কের সারল্য, ছোট্ট ছোট্ট মান-অভিমান, একে-অন্যকে ভাল রাখার, ভালবাসার কোলাজ তাই ঠা ঠা রোদে এক আঁজলা জলের মতোই শান্তির। বিকাশের সততা, খুশবুর সঙ্গে তার দাম্পত্য কিংবা প্রহ্লাদ’চার সঙ্গে জড়িয়ে রাখা মায়ার বাঁধনও ছুঁয়ে যায় আগের মতোই। আর এদের সবার উপরে বনস্পতির মতো ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখে দুটো মানুষ। প্রধানজি আর মঞ্জুদেবী। ঠিক যেমনটা হতো আগেকার যৌথ পরিবারে। ভোটের গল্পে দর্শকও কি তাই শেষমেশ নিরপেক্ষ থাকতে পারেন? বোধহয় না! 
মেঠো সুরে, মিঠে তারে বাঁধা কাহিনিতে বরাবরের মতোই একেবারে মাটির কাছাকাছি অভিনয়ে মন কাড়েন প্রত্যেকেই। ভালবাসা আদায় করে ছাড়েন আলাদা আলাদা করে। তবে আগের সিজনে যেমন নায়ক হয়ে উঠেছিলেন প্রহ্লাদ’চা, এবারে সেই জায়গায় বিনোদ। প্রাণ ঢেলে অভিনয় করে, স্রেফ সারল্যেই যেন সবাইকে যেন ছাপিয়ে গেলেন অশোক।
 
 সিরিজের শেষপাত বলছে পঞ্চম সিজন আসবেই। পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র কিংবা কাহিনিকার চন্দন কুমারের হাত ধরে সে কবে এসে পৌঁছয়, ফের তার হাপিত্যেশ অপেক্ষার পালা। রাজনীতির কাঁটা উপড়ে চেনা ফুলেরায় আবারও কি ছড়াবে সহজ সম্পর্কের ফুল ফোটানো অপার্থিব মিষ্টি গন্ধ? নাকি আরও প্যাঁচঘোঁচে জট পাকিয়ে ঘোর বাস্তবে এসে দাঁড়াবে? সে তো সময়ই বলবে!
