অংশুমান কর
এত হিংস্র বাঙালি জাতিকে আমি খুব কম দেখেছি। বেদনার সঙ্গেই এই কথাটা বলতে হল। সারাক্ষণই আমরা যেন মুখিয়ে রয়েছি একজন মানুষের খোঁজে। যার দিকে একের পর এক আমরা ছুড়তে থাকব ঢিল, পাথর, বিষ্ঠা। ছুড়ে শান্ত হব নিজেরা। নানা অপ্রাপ্তি আর অসাম্যের শিকার হতে হতে ভেতরে যে রাগটা সারাক্ষণ টগবগ করে ফুটছে, তাকে চালিত করে দেব ট্রোলের ওই লক্ষ্যবস্তুটির দিকে। আমাদের সোনার মেয়েগুলো ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার পর এই ট্রোলের লক্ষ্যবস্তু হয়ে গিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। যে দাদাকে নিয়ে একদিন বাঙালি পাগল ছিল, আজ প্রতি মুহূর্তেই তাঁকে আক্রমণ করে এক অদ্ভুত আনন্দ পাচ্ছে। বিশ্বকাপ জেতার উন্মাদনা এখন খানিক থিতিয়ে যাওয়ার পর এই প্রশ্ন কিন্তু করতে ইচ্ছে করছে, এতখানি আক্রমণ সৌরভের প্রাপ্য কি?
আক্রমণ হচ্ছে কেন? ২০১৩ সালে একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে সৌরভের বলা একটি বাক্যই এর কারণ। শচীন তেন্ডুলকারের অবসরগ্রহণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান। সেখানে শচীন পুত্র অর্জুনের ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গেই সঞ্চালক সৌরভকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, সানা ক্রিকেট খেলতে চাইলে উনি কী করবেন? উত্তরে সৌরভ বলেছিলেন, মেয়েদের ক্রিকেট খেলার দরকার নেই। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও অনেক কিছুই বলেছিলেন। সেই সমস্ত কথাকেই বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এই অংশটুকু কেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজমাধ্যমে। এটা আজ সম্ভব। প্রযুক্তির কল্যাণে সম্ভব। আগে ভিডিও এডিট করা এতখানি সহজ ছিল না। ট্রোল-মস্তানদের যে দাপাদাপি আজ সমাজমাধ্যমে দেখা যায় তার একটি বড় কারণ হচ্ছে প্রযুক্তি একদিক থেকে আজ সমস্ত নাগরিককে ভুল সমানাধিকার দিয়ে বসে আছে। বলে রাখা ভালো যে, সেই সাক্ষাৎকারে সানার ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গে যে মন্তব্যটি সৌরভ করেছিলেন, তাকে সমর্থন করছি না। করা যায় না। কিন্তু মেয়েদের ক্রিকেট সম্পর্কে এটিই কি সৌরভ গাঙ্গুলীর একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি?
কতগুলো তথ্য দেওয়া যাক। বিশ্বকাপ যাঁর হাতে উঠেছে ভারতীয় ক্রিকেট মহিলা দলের সেই অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর একবার কী বলেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী সম্পর্কে? ২০২০ সালে ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ বাতিল হওয়ার পর ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটাররা হতাশ পড়েছিলেন। ঠিক তখনই, তাঁদের হতাশা কাটাতে বিসিসিআই ঘোষণা করেছিল মহিলাদের টি-২০ চ্যালেঞ্জ আয়োজনের। ঘোষণা করেছিল অক্টোবর মাসে আরও দুটি আন্তর্জাতিক সিরিজেরও। এই সিদ্ধান্তগুলির পেছনে ছিলেন বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি। হরমনপ্রীত তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, 'সৌরভ স্যার আমাদের প্রতিটি সুযোগের কথাই ভাবছেন, আর মহিলা ক্রিকেটের জন্য তিনি যা করছেন, তা সত্যিই অনন্যসাধারণ।' ভুলে গেলে চলবে না যে, ২০১৯ সালে বিসিসিআই-এর সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে পুরুষ ক্রিকেটের সমান গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে গেছেন সৌরভ। বোর্ডের বিভিন্ন বৈঠক ও সাক্ষাৎকারে তিনি মহিলা ক্রিকেটের জন্য আলাদা পরিকাঠামো ও সুযোগ তৈরি করার জন্য জোর সওয়াল করেছেন বারবার। ২০১৯ সালে এই মহিলা ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সিরিজগুলিকে পুরুষদের টুর্নামেন্টের সমান প্রচার দেওয়ার উদ্দেশ্যে টিভি সম্প্রচার ও প্রচারণা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন বোর্ড সভাপতি সৌরভ। পরের বছর, ২০২০-তে, পুরুষদের মতো মহিলা ক্রিকেটারদেরও গ্রেড ভিত্তিক বেতন কাঠামোর প্রস্তাব করেছিলেন সৌরভই। ২০২০ সালেই প্রথমবার মহিলা আইপিএল নিয়ে আলোচনাও শুরু হয় সৌরভের তত্ত্বাবধানেই। তাঁরই উদ্যোগে ‘উইমেনস টি২০ চ্যালেঞ্জ’-এর পরিধি বাড়ানো হয়, এর মধ্যেই বীজ ছিল ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগের। ২০২১ সালে মহিলা ক্রিকেটারদের কেন্দ্রীয় চুক্তির কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনা হয়। সৌরভের নেতৃত্বে বোর্ড মাঠে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি আরও জোরদার করে। একই বছর অনুমোদন পায় আন্ডার সিক্সটিন গার্লস ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট, যা দীর্ঘদিন পরিকল্পনার স্তরেই ছিল। সেই বছরেই রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয় মেয়েদের জন্য পৃথক কোচিং প্রোগ্রাম, লিগ ও অ্যাকাডেমি চালু করতে। ২০২২ সালে সৌরভের সভাপতিত্বেই বিসিসিআই ঘোষণা করে মহিলা ও পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান ম্যাচ ফি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। সেই বছরই মহিলা আইপিএলের রূপরেখাও চূড়ান্ত হয়, যা ছিল সৌরভের সভাপতিত্বে মেয়েদের ক্রিকেটে শেষ বড় সিদ্ধান্ত। এখন যাঁরা বারবার বলার চেষ্টা করছেন যে, উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ চালু করার পেছনে সৌরভের কোনোই অবদান নেই, তাঁরা আসলে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন।
কাজেই একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মহিলাদের ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে সৌরভের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচার করা উচিত হচ্ছে না। মহিলাদের ক্রিকেটকে সৌরভ কীভাবে দেখেন তা বুঝতে গেলে মাথায় রাখতে হবে ওপরের তথ্যগুলিও। প্রশ্ন হল, তাহলে ২০১৩ সালে তিনি ওই রকম একটি মন্তব্য করেছিলেন কেন? এটি ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ফসল একজন বাবার মন্তব্য। আমরা যারা ফেসবুকে সৌরভের সমালোচনায় আজ গলা ফাটাচ্ছি তারাও কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব মহিলাদের এই ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয়ের পরেও আমরা বাড়ির মেয়েটিকে প্যাড, গ্লাভস পরিয়ে ব্যাট হাতে ক্রিকেটের মাঠে পাঠিয়ে দিতে পারব? পারব এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিতে? পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা সৌরভের ওই মন্তব্যে স্পষ্ট। কিন্তু সেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল আমরা অনেকেই। তাঁর রাজনৈতিক মতামত, অবস্থান আমাদের অনেকেরই পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু মেয়েদের ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গে সৌরভকে দোষী চিহ্নিত করে ট্রোল করার আগে আমাদের অনেকেরই একবার নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
