আজকাল ওয়েবডেস্ক: সমাজমাধ্যমে হোক বা চায়ের দোকানের আড্ডায়, এমন মানুষের দেখা প্রায়শই মেলে যাঁরা কোনও একটি বিষয়ে সামান্য জ্ঞান নিয়েই নিজেদের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করেন। সামান্য দু-একটি বই পড়েই কোয়ান্টাম ফিজিক্স থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি, সব কিছু নিয়েই তাঁরা চূড়ান্ত মতামত দিয়ে দেন। এই আত্মবিশ্বাস দেখে অনেক সময়েই প্রকৃত বিশেষজ্ঞরা অবাক হন। সাধারণ মানুষ ভাবেন, এত আত্মবিশ্বাস যখন, তখন নিশ্চয়ই কিছু জানেন! কিন্তু মনস্তত্ত্ব বলছে, এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে এক গভীর অজ্ঞানতা। এই মনস্তাত্ত্বিক ভ্রান্তিরই নাম ‘ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট’।

 

কী এই ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট?

বিজ্ঞানের ভাষায় ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট হল এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পক্ষপাত, যেখানে কোনও একটি বিষয়ে কম জ্ঞান বা অদক্ষ ব্যক্তিরা নিজেদের যোগ্যতাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বলে মনে করেন। আরও সহজ ভাষায় বললে, নিজের অযোগ্যতাকে বোঝার মতো যোগ্যতাও তাঁদের থাকে না। ফলে তাঁরা এক ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাসে ভোগেন। ১৯৯৯ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ ডেভিড ডানিং এবং জাস্টিন ক্রুগার প্রথম এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিষয়টি সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।

তাঁদের গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তি, ব্যাকরণ এবং রসবোধের মতো বিষয়ে যাঁদের পারদর্শিতা সবচেয়ে কম, তাঁরাই নিজেদের দক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি করে প্রচার করেন। অন্যদিকে, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানী, তাঁরা বরং নিজেদের দক্ষতাকে কিছুটা কম করে দেখেন।

 

মুদ্রার অপর পিঠ

ডানিং-ক্রুগার এফেক্টের কেবল একটি দিক নেই। এর একটি বিপরীত দিকও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা কোনও বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ বা পারদর্শী, তাঁরা প্রায়শই নিজেদের জ্ঞান বা দক্ষতাকে বাকিদের তুলনায় কম করে দেখেন। এর কারণ হল, যে কাজটি তাঁদের কাছে অত্যন্ত সহজ বলে মনে হয়, তাঁরা ধরে নেন সেই কাজটি অন্যদের কাছেও ততটাই সহজ। ফলে, তাঁরা নিজেদের দক্ষতাকে একটি সাধারণ বিষয় বলে গণ্য করেন এবং বাকিদের তুলনায় নিজেদের খুব একটা এগিয়ে রাখতে চান না। এই বিনয় বা আত্ম-সংশয়ও ডানিং-ক্রুগার এফেক্টেরই একটি অংশ।

 

বাস্তব জীবনে এর প্রভাব

কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সর্বত্রই ডানিং-ক্রুগার এফেক্টের প্রভাব দেখা যায়। একজন অদক্ষ কর্মী হয়তো মনে করতে পারেন তিনিই অফিসের সেরা, যাঁর ফলে তিনি গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন না এবং তাঁর উন্নতিও থমকে যায়। আবার, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ব্যাপক প্রসারের পিছনেও এই এফেক্ট অনেকাংশে দায়ী। সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা কোনও কিছু যাচাই না করেই নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যা বৃহত্তর সমাজকে বিভ্রান্ত করে।

 

মুক্তির উপায় কী?

ডানিং-ক্রুগার এফেক্টের জাল থেকে বেরোনোর প্রথম ধাপই হল আত্ম-সচেতনতা। নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং ক্রমাগত নতুন কিছু শেখার মানসিকতা রাখাই এর থেকে মুক্তির সেরা উপায়। সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি, “আমি কেবল একটি জিনিসই জানি, এবং তা হল আমি কিছুই জানি না”-এই দর্শনেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত জ্ঞানের চাবিকাঠি। নিরন্তর শেখা এবং অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমেই এই মনস্তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব।