আজকাল ওয়েবডেস্ক: আধুনিক সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়লেও যৌন আচরণজনিত ব্যাধি বা Sexual Behaviour Disorder নিয়ে এখনও প্রচুর ভুল ধারণা ও নীরবতা বিরাজ করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি এমন এক মানসিক ও আচরণগত সমস্যা, যেখানে ব্যক্তির যৌন আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা বা আচরণ সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, আত্মবিধ্বংসী বা অন্যের প্রতি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যাই নয়, সামাজিক ও নৈতিক সংকটেরও ইঙ্গিত বহন করে।
মনোবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, যৌন আচরণজনিত ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কেউ কেউ অস্বাভাবিক মাত্রায় যৌন সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষায় ভোগেন, যাকে হাইপারসেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার বলা হয়। আবার কারও মধ্যে দেখা যায় অন্যের প্রতি গোপনে যৌন আগ্রহ বা নজরদারির প্রবণতা, যা ভয়োরিজম নামে পরিচিত। তেমনি কিছু ক্ষেত্রে অন্যের অজ্ঞাতে বা অনিচ্ছায় স্পর্শ বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করার প্রবণতা ফ্রোটিউরিজম বা এক্সিবিশনিজম রূপে প্রকাশ পায়। এ ছাড়া শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ (পেডোফিলিয়া), বস্তুর প্রতি যৌন আসক্তি (ফেটিশিজম) কিংবা ব্যথা ও যন্ত্রণার সঙ্গে যৌন আনন্দ যুক্ত করা (স্যাডোম্যাসোকিজম)—এসবই এই ব্যাধির অন্তর্গত।
চিকিৎসকদের মতে, এই সমস্যার পেছনে রয়েছে মানসিক, জৈবিক ও সামাজিক নানা কারণ। শৈশবে নির্যাতনের শিকার হওয়া, যৌনতা নিয়ে অপর্যাপ্ত শিক্ষা, পরিবারে হিংসা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, কিংবা দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ—এসবই অনেক সময় এই ব্যাধিকে জন্ম দেয়। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতাও অনেককে অস্বাভাবিক যৌন অভ্যাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৮ সালে প্রকাশিত International Classification of Diseases (ICD-11)-এ যৌন আচরণজনিত ব্যাধিকে মানসিক অসুস্থতার একটি স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যখন কারও যৌন আকাঙ্ক্ষা বা আচরণ অন্তত ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং তা তার নিজের জীবনে, পেশায়, সম্পর্ক বা সামাজিক পরিসরে সমস্যা সৃষ্টি করে, তখন সেটি চিকিৎসাযোগ্য ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভারতে ও বাংলাদেশে এই বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা এখনো খুব সীমিত। অনেক সময় পরিবার ও সমাজে এ নিয়ে কথা বলাকে ‘লজ্জার বিষয়’ মনে করা হয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসার বদলে গোপনীয়তা ও আত্মগ্লানিতে ভোগেন, যা ধীরে ধীরে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও সৃষ্টি করতে পারে। কলকাতা ও ঢাকা—উভয় শহরেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে অন্তত ১ জন কোনো না কোনো যৌন আচরণজনিত সমস্যায় ভুগছেন, যদিও তাঁরা সচরাচর চিকিৎসা নেন না।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও প্রয়োজনে ওষুধপ্রয়োগ—সবই কার্যকর হতে পারে। Cognitive Behavioural Therapy (CBT) বা আচরণগত থেরাপি আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিজের প্রবৃত্তি ও চিন্তার ধারা বুঝতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে সেরোটোনিন-নির্ভর অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট ওষুধও দেওয়া হয়, যা অতিরিক্ত যৌন তাগিদ কমাতে সাহায্য করে। তবে চিকিৎসকদের মতে, শুধু ওষুধ নয়, সমাজ ও পরিবারকে সচেতন করা এবং যৌন শিক্ষাকে মানসিক স্বাস্থ্যচর্চার অংশ করা জরুরি।
মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে এই ব্যাধিকে “নৈতিক অবক্ষয়” হিসেবে দেখলে সমস্যা আরও গভীর হয়। এটিকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে গ্রহণ করে সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনই হলো সঠিক পথ। সমাজ যদি এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে অনেক মানুষ লজ্জা বা ভয় না পেয়ে চিকিৎসার আওতায় আসতে পারবেন।
সবশেষে বলা যায়, যৌন আচরণজনিত ব্যাধি আজকের সমাজে এক নীরব কিন্তু বাস্তব সমস্যা। এটি শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজেরও দায়িত্ব—একে স্বীকৃতি দেওয়া, বোঝা এবং সময়মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নই মানবিক সমাজের ভিত্তি।
