আরজি কর হাসপাতালের মুকুটে লাগছে নতুন পালক। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে সচেতনতার একাধিক পদক্ষেপ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের শহর থেকে গ্রাম প্রতিটা ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যাতে কোনও সমস্যা না হয় এবং চিকিৎসা পরিষেবায় যাতে আর্থিক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড থেকে শুরু করে একাধিক পরিকল্পনা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সাধারণ মানুষের যাতে সরকারি হাসপাতালগুলিতেই চিকিৎসার দিকে ঝোঁক বাড়ে তার জন্য কলকাতা এবং জেলাগুলিতে একাধিক নিত্যনতুন পরিষেবা চালু করেছেন। বিবিধ অত্যাধুনিক পরিষেবা চালু হয়েছে। এবার আর জি কর হাসপাতালে চালু করা হল অটো ইমিউন ডিজিজ চিকিৎসায় অত্যাধুনিক পরিষেবা। বায়ো কেমিস্ট্রি বিভাগে অত্যাধুনিক মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ ধরনের জটিল রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
অটোইমিউন ডিজিজ-এর রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য অন্য কোনও সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হবে না আরজি কর হাসপাতালকে। খুব সহজে খুব অল্প সময়েই এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। হাসপাতালে চিকিৎসকদের মতে পূর্বে এই ধরনের অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারণে এসএসকেএম হাসপাতালের উপর নির্ভর করতে হত। অপেক্ষা করতে হত ৮ থেকে ১০ দিন।
অটোইমিউন ডিজিজ কী?
অটোইমিউন রোগ (Autoimmune Disease) হল এমন এক ধরনের অবস্থা যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) ভুলবশত শরীরের নিজের সুস্থ কোষ ও টিস্যুকে আক্রমণ করে। এই ধরনের রোগের লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত ক্লান্তি, গাঁটে ব্যথা ও ফোলা দেখা যায় এবং লক্ষণগুলি মাঝে মধ্যেই আসা-যাওয়া করে। বর্তমানে ৮০টিরও বেশি ধরনের অটোইমিউন রোগ চিহ্নিত হয়েছে। যেমন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis), ও লুপাস (Lupus)। এই রোগ শরীরের নানা অঙ্গ ও অংশকে প্রভাবিত করতে পারে।
অটোইমিউন রোগে কী ঘটে?
১. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি: স্বাভাবিক অবস্থায় ইমিউন সিস্টেম ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মতো ক্ষতিকারক জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু অটোইমিউন রোগে এই সিস্টেমটি ভুলবশত শরীরের নিজের সুস্থ কোষ ও টিস্যুকে ‘বিদেশি আক্রমণকারী’ বলে চিহ্নিত করে ফেলে।
২. সুস্থ টিস্যুতে আক্রমণ: এরপর ইমিউন সিস্টেম এই সুস্থ টিস্যুগুলোর ওপর আক্রমণ শুরু করে, যার ফলে শরীরে প্রদাহ (inflammation) ও টিস্যুর ক্ষতি হয়।
অটোইমিউন রোগের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এটি জেনেটিক (বংশগত) ও পরিবেশগত কারণের মিলিত প্রভাবের ফল হতে পারে। এছাড়াও নির্দিষ্ট ভাইরাসের সংক্রমণ (Certain viruses)-এর কারণে এই রোগ দেখা দিতে পারে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই রোগ তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।
নির্ণয় ও চিকিৎসা
অটোইমিউন রোগ নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন, কারণ এর লক্ষণ অনেক অন্যান্য রোগের সঙ্গে মিলে যায়। নির্ণয়ের জন্য সাধারণত চিকিৎসক রোগীর লক্ষণসমূহ পর্যবেক্ষণ করেন এবং রক্ত পরীক্ষা করেন। প্রয়োজনে টিস্যুর বায়োপসি করা হয়।
চিকিৎসা
বেশিরভাগ অটোইমিউন রোগের এখনও স্থায়ী কোনও চিকিৎসা নেই। তবে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও শরীরের ক্ষতি প্রতিরোধের জন্য নানা চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, প্রদাহ কমাতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (Anti-inflammatory drugs), কর্টিকোস্টেরয়েডস (Corticosteroids) এবং ইমিউন সিস্টেম দমনকারী ওষুধ (Immune-suppressing medications)। এছাড়াও, সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে এবং রোগীর জীবনমান উন্নত করে।

আরজি কর হাসপাতালে এই নবতম সংযোজন বায়ো কেমিস্ট বিভাগে অত্যাধুনিক মেডিকেল ইকুইপমেন্ট পরিষেবা নিয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক জয়ন্ত দে বলেন, “কলকাতা তথা রাজ্যে এসএসকেএম হাসপাতালের পর আরজি কর হাসপাতালে এই ধরনের পরিষেবা চালু হতে যাচ্ছে। রাজ্যবাসীর জন্য এক বিরাট সুখবর। আগে আমাদের এই ধরনের চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ের জন্য ৮ থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হত। কারণ, এসএসকেএম হাসপাতালেই শুধুমাত্র এ ধরনের পরিষেবা ছিল। মেডিকেল কলেজ বা এনআরএস হসপিটালে এই পরিষেবা রয়েছে কিন্তু সেটি অতি সাধারণ এবং এত অত্যাধুনিক নয়। এসএসকেএম হাসপাতালের পর এত অত্যাধুনিক পরিষেবা এবার আরজি কর হাসপাতালে চালু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয়বার। সে ক্ষেত্রে খুব সহজেই বলা যায়, অটো ইমিউন ডিজিজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ এক যুগান্তকারী দিক আনবে।”
তিনি আরও বলেন, ”আমি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগকে আবেদন জানিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, সরকার তা মান্যতা দিয়েছে যা আমাদের হাসপাতালের জন্য অতি গর্বের। আগামী আর কয়েক দিনের মধ্যেই এই পরিষেবা চালু হয়ে যাবে। এ ধরনের চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্টই ব্যয়বহুল, যা রাজ্য সরকার বিনামূল্যে পরিষেবা দেবে, এর জন্য এক টাকাও লাগবে না। সত্যি সাধারন মানুষের জীবনে এবং রোগীদের ক্ষেত্রে অতি সুখবর আরজি কর হাসপাতালে। এর জন্য আমরা খুব আনন্দিত এবং গর্বিত।”
