আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলাদেশের প্রাক্তন  মন্ত্রী মোহিবুল হাসান চৌধুরী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এমন এক বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন, যা ঢাকার রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কিছু প্রভাবশালী পরিবার ও এনজিও—বিশেষত ইউএসএইড (USAID) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (IRI)—২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পেছনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল।

রাশিয়া টুডে (RT)-এর এক সাক্ষাৎকারে চৌধুরী বলেন, এসব সংগঠন ও ব্যক্তিরা “অর্থের গোলকধাঁধা” তৈরি করে বাংলাদেশের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে অর্থায়ন করেছিল। তাঁর ভাষায়, “এই তহবিলের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের, এমনকি জঙ্গি ও উগ্রপন্থীদের, হিজড়েদেরও টাকা দেওয়া হয়েছিল, যাতে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়।”

চৌধুরীর মতে, ২০১৮ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংগঠন শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছিল। “এটা ছিল এক পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা। সেই অর্থ দিয়ে কর্মী, শিল্পী, এমনকি হিজড়ে সম্প্রদায়কেও ব্যবহার করা হয়েছিল। এক সময় এই বিশৃঙ্খলাকে হিংসাত্মক দাঙ্গায় পরিণত করা হয়,” তিনি বলেন।

‘আমেরিকার প্রভাবশালী পরিবারগুলোর যোগসাজশ’

চৌধুরী সরাসরি অভিযোগ করেন যে, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রভাবশালী পরিবার—বিশেষ করে বাইডেন, ক্লিনটন ও সোরোস পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তাঁর মতে, এই সম্পর্কই শেখ হাসিনার পতনের মূল পেছনের শক্তি। “এই পরিবারগুলোর ইচ্ছা বা সহায়তা ছিল দাঙ্গাকারীদের পেছনে। ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ও ইউনূসের সম্পর্ক বহু পুরনো। তাঁদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন,” বলেন সাবেক এই মন্ত্রী।

‘রেজিম চেঞ্জ’ তহবিল ও অস্বচ্ছ অর্থ প্রবাহ

চৌধুরী জানান, দুটি এনজিওর মাধ্যমে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, যার কোনও  স্বচ্ছ হিসাব নেই। তাঁর অভিযোগ, এই অর্থ “রেজিম চেঞ্জ” বা সরকার বদলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। “ইউএসএইড ও আইআরআইয়ের অর্থের গন্তব্য অস্পষ্ট। এই টাকার বড় অংশ গিয়েছে আন্দোলন সংগঠনে, এমনকি প্রশিক্ষিত দাঙ্গাকারীদের কাছে,” বলেন তিনি।

‘পরিকল্পিত সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড’

প্রাক্তন এই মন্ত্রী দাবি করেন, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভগুলি আদতে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। বরং সেগুলোতে ইসলামপন্থী ও উগ্র গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং পশ্চিমী  শক্তির সহায়তায় তা সরকারবিরোধী দাঙ্গায় রূপ নেয়। “স্নাইপার ব্যবহার, প্রশিক্ষিত দাঙ্গাকারী, হত্যা—সবই সেই পরিকল্পিত নকশার অংশ ছিল,” চৌধুরী বলেন।

‘মুহাম্মদ ইউনূসের উত্থান ও নীতিগত পরিবর্তন’

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপ থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর থেকেই বাংলাদেশের নীতি ও অবস্থানে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
চৌধুরীর দাবি, “ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্রনীতি এখন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাবাধীন। দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দূরত্বে ঠেলে দিয়েছে।”

এমনকি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন ও পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের গণহত্যা নিয়ে নরম অবস্থানও বর্তমান প্রশাসনের নীতিগত পরিবর্তনের অংশ বলে তিনি অভিযোগ করেন।

পটভূমি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুতই সহিংস আকার ধারণ করে। শতাধিক প্রাণহানি ও ব্যাপক অরাজকতার পর শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি নয়া দিল্লিতে নির্বাসিত অবস্থায় রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

জাটিয়া পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে লিখেছেন যে, “ছাত্র আন্দোলনের পেছনে ইসলামপন্থী উপাদানগুলির অনুপ্রবেশ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নীরব ভূমিকা শেখ হাসিনার পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল।”

‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের আড়ালে পশ্চিমী প্রভাব’

চৌধুরীর ভাষায়, “গণতন্ত্র ও উন্নয়ন” ছিল কেবল একটি মুখোশ। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে সরিয়ে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যা ওয়াশিংটনের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, “আমেরিকার কিছু এনজিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ চালানো হচ্ছিল। এটাই ছিল সেই ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর প্রকৃত রূপ।”

যদিও যুক্তরাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনও  আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, চৌধুরীর এই বক্তব্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাব ও অর্থ যোগানের  প্রসঙ্গকে আবারও সামনে এনে দিল, যেখানে দেশীয় রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বার্থের সংঘাত নতুন এক মাত্রা পেয়েছে।