আজকাল ওয়েবডেস্ক: গত দুই দশক ধরে প্রযুক্তি জায়ান্টরা নিজেদেরকে প্রায় সার্বভৌম সত্ত্বা ভেবে এসেছে। গুগল ঘোষণা করেছিল “বিশ্বের তথ্য সংগঠিত” করার। ফেসবুক চেয়েছিল “বিশ্বকে যুক্ত” করতে। মাইক্রোসফট চালাত মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত ক্লাউড অবকাঠামো, সীমান্তের তোয়াক্কা না করেই। এমনকি টুইটারও নিজেকে আমেরিকান কোম্পানি নয়, বরং বিশ্বের টাউন স্কয়ার হিসেবে কল্পনা করত।


কিন্তু সেই ভ্রম ভেঙে গেছে। টিকটক কাহিনি—যা শেষমেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শর্তযুক্ত অনুমোদনের মাধ্যমে একটি কাঠামোগত বিভাজনে পৌঁছেছে—একটি বড় মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ইতিহাসে প্রথমবার, একটি বড় সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মকে কোনও রাষ্ট্রের জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে নিজেকে পুনর্গঠন করতে হয়েছে। টিকটক হয়তো প্রথম ডমিনো, কিন্তু শেষ নয়।


২০০০ ও ২০১০-এর দশক ছিল সুপ্রা-ন্যাশনাল যুগ। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের ইউটিলিটি মনে করত। তাদের আনুগত্য ছিল ব্যবহারকারী, শেয়ারহোল্ডার ও ইকোসিস্টেমের প্রতি—রাষ্ট্রের প্রতি নয়। 

আরও পড়ুন: শরীরে কোথায় চর্বি জমছে, তাতেই লুকিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি


২০২০-এর পর শুরু হয় জাতীয় নিরাপত্তার যুগ। টিকটক ভারতে নিষিদ্ধ হয়। পশ্চিমের 5G নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়েকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেমিকন্ডাক্টর হয়ে ওঠে মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুদ্ধক্ষেত্র। প্রযুক্তি তখন আর কেবল ব্যবসা নয়—বরং কৌশলগত সম্পদ, সম্ভাব্য হুমকি ও কূটনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার।


এখন আমরা প্রবেশ করছি জিও-ন্যাশনাল যুগে। কোম্পানিগুলোকে জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের কাঠামো, সাপ্লাই চেইন ও শাসনব্যবস্থা সাজাতে হচ্ছে। টিকটকের বিভাজন সবচেয়ে দৃশ্যমান উদাহরণ। একইভাবে, এনভিডিয়া চীনে উন্নত GPU পাঠাতে পারে না। বিরল খনিজ পদার্থ মজুদ করা হচ্ছে। এআই নিয়েও জাতিগুলো সক্রিয়—ইউরোপীয় ইউনিয়ন এনেছে AI Act, যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক্সিকিউটিভ অর্ডার, আর চীন চালু করেছে অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ। বার্তাটি স্পষ্ট: প্রযুক্তি আর সীমাহীন অবকাঠামো নয়, এটি জাতীয় অবকাঠামো, আর তাই রাজনৈতিক।


অনেকে বলেন, পরিবর্তনটা অতিরঞ্জিত। গুগল, মেটা, মাইক্রোসফট এখনও শতাধিক দেশে চলছে। এআই গবেষকরা বিশ্বজুড়ে একসঙ্গে কাজ করেন। ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাও অনেকাংশে রয়ে গেছে। কিন্তু গভীরে সত্য ভিন্ন। মালিকানা, শাসন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো ক্রমেই জাতীয় স্বার্থকে প্রতিফলিত করছে। বাইরে থেকে প্ল্যাটফর্মগুলো এক হলেও ভেতরে ভেতরে তারা আলাদা আলাদা জাতীয় সংস্করণে বিভক্ত হচ্ছে।


ভারত এই কাহিনিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে—২০২০-এ টিকটক নিষিদ্ধ করে। সেই সিদ্ধান্ত কেবল নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং ডিজিটাল অবকাঠামোর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এরপর ভারত নিজস্ব ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ছে—UPI থেকে ONDC পর্যন্ত।


টিকটক কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার গল্প নয়; এটি এআই-এর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। আজ এআই সীমাহীন মনে হলেও শিগগিরই প্রশ্ন উঠবে: কে ডেটা নিয়ন্ত্রণ করবে? কে চিপ নিয়ন্ত্রণ করবে? কে মডেল নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রতিটি উত্তর আসবে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে।


ব্যবসায়ীদের জন্য বার্তা হল—গ্লোবাল স্কেলিং মানে এখন শুধু পণ্য নয়, বরং নীতিমালা মেনে চলার কৌশল। বিনিয়োগকারীদের জন্য জাতীয় ঝুঁকি নতুন বাজার ঝুঁকি। নীতিনির্ধারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হল—সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা, তবে উদ্ভাবনকে দমিয়ে না দেওয়া।


ভারতের উদাহরণ শেখায়—সার্বভৌমত্ব ও উন্মুক্ততা পাশাপাশি থাকতে পারে। দরকার “নেটওয়ার্ক অফ নেটওয়ার্কস”, যেখানে দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ রাখবে, কিন্তু ব্যবহারকারী ও ব্যবসাগুলো আন্তঃসংযোগ থেকে লাভবান হবে। টিকটক কাহিনি কোনও ব্যতিক্রম নয়; এটি আগামী দশকের পূর্বাভাস। সোশ্যাল মিডিয়া, এআই, সেমিকন্ডাক্টর, বিরল খনিজ—সবই রাজনীতির আকর্ষণ বলয়ে ঢুকে যাচ্ছে।