আজকাল ওয়েবডেস্ক: জেন জি গণবিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক মাস পরেও নেপালের কমিউনিস্ট রাজনীতিতে নিজের দাপট অটুট রাখলেন কে.পি. শর্মা অলি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল–ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট (সিপিএন–ইউএমএল)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হলেন তিনি। সদ্যসমাপ্ত দলীয় সম্মেলনে তাঁর এই জয় কার্যত প্রমাণ করে দিল রাজপথে জনরোষ ও সরকার পতনের অভিঘাত সত্ত্বেও দলীয় সংগঠনের ভেতরে অলির কর্তৃত্ব এখনো অটল।

দলীয় সূত্র অনুযায়ী, মোট ২,২২৭ জন প্রতিনিধির মধ্যে অলি পেয়েছেন ১,৬৬৩টি ভোট যা প্রায় ৭৫ শতাংশ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঈশ্বর পোখরেল পেয়েছেন মাত্র ৫৬৪টি ভোট। এই বিপুল ব্যবধান অলির নেতৃত্বকে কার্যত প্রশ্নাতীত করে তুলেছে।

সিপিএন–ইউএমএল-এর শীর্ষ নেতৃত্বে অলির উত্থান শুরু ২০১৫ সালে, যখন তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপালকে পরাজিত করে প্রথমবার দলের চেয়ারম্যান হন। ২০২১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ভীম রাওয়ালকে হারান। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই পরে দল ছেড়ে পুষ্প কমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’-এর নেতৃত্বাধীন অন্য একটি কমিউনিস্ট জোটে যোগ দেন।

২০১৫ সালের পর থেকে অলি ধারাবাহিকভাবে দলীয় বিরোধী গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করেছেন এবং একই সঙ্গে রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার কিছু অংশের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছেন। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়া নেপালে এই কৌশল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর ফলে একসময় বহু ভাগে বিভক্ত  সিপিএন–ইউএমএল ধীরে ধীরে একক নেতৃত্বনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে।

এইবারের দলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক চাপের মধ্যে। গত ৮-৯ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে জেন জি গণবিক্ষোভে অলির সরকারের পতন হয় এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। বিক্ষোভের পর দলের ভেতর থেকেই অলিকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়েছিল। অনেক নেতা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, অলির নেতৃত্বে থাকলে ২০২৬ সালের ৫ মার্চ নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনে দলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যুব আন্দোলনের মূল দাবিই ছিল নেপালের রাজনীতিতে প্রজন্মগত পরিবর্তন।

কিন্তু সম্মেলনের ফলাফল স্পষ্ট করে দিয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন। চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি দলের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদেই অলিপন্থীরা জয়ী হয়েছেন।

সাধারণ সম্পাদক পদে অলির ঘনিষ্ঠ শঙ্কর পোখরেল ১,২২৮ ভোট পেয়ে পদটি ধরে রাখেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সুরেন্দ্র পাণ্ডে পেয়েছেন ৯৯৯ ভোট। অফিস বেয়ারারদের মধ্যে অলি বিরোধী বা পোখরেল বিরোধী গোষ্ঠী মাত্র দুটি পদ জিততে সক্ষম হয়েছে- গোকর্ণ বিস্তা ও যোগেশ ভট্টরাই।

এই নির্বাচনকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারির রাজনৈতিক প্রভাবের পরীক্ষাও বলা হচ্ছিল। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নেপালের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ভাণ্ডারি প্রকাশ্যে ঈশ্বর পোখরেলের পক্ষে অবস্থান নেন। রাজনৈতিক মহলে ধারণা ছিল পোখরেল জিতলে ভাণ্ডারি সক্রিয় রাজনীতিতে, বিশেষ করে সিপিএন-ইউএমএল-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, প্রত্যাবর্তনের পথ পাবেন।

এই সম্ভাবনা আগেই রুখতে অলি ভাণ্ডারির দলীয় সদস্যপদ বাতিল করেছিলেন। সম্মেলনে পোখরেলের ভরাডুবি- মাত্র এক চতুর্থাংশ ভোট, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দলের ভেতরে ভাণ্ডারির রাজনৈতিক প্রভাব  এখন সীমিত। প্রতিনিধি মারফত দলকে প্রভাবিত করার তাঁর কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

চার বছরের নতুন মেয়াদে অলি এখন নেপালের প্রধান বিরোধী শক্তির নেতা হিসেবে রাজনৈতিক ময়দানে থাকবেন। যুব আন্দোলনের পর ক্ষমতাচ্যুত হলেও তিনি নতুন নির্বাচনের দাবি নাকচ করে সংসদ ফের চালু করার  দাবিতে অনড়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনি “অসাংবিধানিক” বলে অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক সংকটের পর প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অস্থায়ীভাবে কার্যনির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন।

এই অবস্থান সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ৮-৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলি তদন্তে গঠিত কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছেন অলি। তাঁর দাবি, “জাতীয়তাবাদী অবস্থানের” কারণে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিদেশি শক্তির মদতে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযোগের ইঙ্গিত মূলত ভারতের দিকেই।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অলির রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রীয় উপাদান। ২০১৬ সালে তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন এমন এক সময়ে, যখন ভারতীয় অর্থনৈতিক অবরোধে নেপালের আমদানি ব্যবস্থা কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরে ২০১৮ সালে এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ২০২৪ সালের মেয়াদেই যুবনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।

তবুও সাম্প্রতিক দলীয় সম্মেলনের ফলাফল স্পষ্ট করে দিচ্ছে রাজপথে বিরোধীতা হলেও সিপিএন–ইউএমএল-এর অভ্যন্তরে কে.পি. শর্মা অলির নেতৃত্ব এখনো প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নেপালের আসন্ন নির্বাচনী রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় এই বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।