আজকাল ওয়েবডেস্ক: অভিজাত সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর পারিবারিক ট্র্যাজেডি আজও অপরাধ মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিদদের আলোচনার বিষয়। এই কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন প্রাক্তন মডেল বারবারা ডালি বেকেল্যান্ড এবং তাঁর একমাত্র পুত্র অ্যান্টনি ওরফে টনি বেকেল্যান্ড। বিলাসী জীবনযাপন, মানসিক অসুস্থতা, বিকৃত পারিবারিক সম্পর্ক এবং ধারাবাহিক হিংসা, সব মিলিয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত গড়ায় এক নৃশংস হত্যা ও এক রহস্যময় মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।
বারবারা ডালি একসময় নিউইয়র্কের সমাজে অত্যন্ত পরিচিত মুখ ছিলেন। প্রাক্তন মডেল হিসেবে তিনি ‘নিউইয়র্কের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাদের’ তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। ১৯৪০-এর দশকে তাঁর বিয়ে হয় ব্রুকস বেকেল্যান্ডের সঙ্গে। ১৯৪৬ সালে তাঁদের একমাত্র সন্তান অ্যান্টনির জন্ম হয়। কিন্তু এই দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়নি। স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক প্রকাশ্যে আসার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বারবারা আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। পরবর্তীতে ব্রুকস আবার বিয়ে করেন এবং নতুন পরিবার গড়ে তোলেন, ফলে বারবারা ও টনি কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
মা-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে পরবর্তী সময়ে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ সামনে আসে। বিভিন্ন সূত্রের দাবি অনুযায়ী, টনি একসময় এক অস্ট্রেলীয় উভকামী পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালে বারবারা তাতে প্রবল আপত্তি জানান। তিনি স্পেনে গিয়ে জোর করে সেই সম্পর্ক ভাঙান এবং ছেলের যৌন সঙ্গীর পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাকে নিষিদ্ধপল্লী পাঠাতে শুরু করেন। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে, অভিযোগ ওঠে যে বারবারা নিজেই ছেলের সঙ্গেই যৌন কাজ শুরু করেন। যদিও এই অভিযোগ কখনও সম্পূর্ণভাবে আদালতে প্রমাণিত হয়নি, বারবারার নিজের স্বীকারোক্তি ও ঘনিষ্ঠ মহলের বিবরণ সমাজে প্রবল আলোড়ন তোলে।
এই সময় থেকেই টনির মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। তাঁর আচরণ ক্রমশ হিংস্র হয়ে ওঠে। মাকে চলন্ত গাড়ির সামনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানো এবং গলা টিপে ধরার মতো ঘটনা একাধিকবার ঘটে। একপর্যায়ে তাঁর স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর এক মানসিক রোগ ধরা পড়ে। তা সত্ত্বেও মা-ছেলে দু’জনেই লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৭২ সালের এক সন্ধ্যায় মা–ছেলের মধ্যে তীব্র বিবাদ বাঁধে। টনি এক বন্ধুকে বাড়িতে ডাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বারবারা তাতে আপত্তি জানান। কথাকাটাকাটি দ্রুত হিংসায় পরিণত হয়। টনি প্রথমে মাকে আঘাত করেন এবং পরে ছুরি দিয়ে একের পর এক কোপ মারেন। পুলিশ এসে তাঁকে রক্তাক্ত দেহের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। গ্রেপ্তারের পর টনি জানায়, সে বিশ্বাস করত তার মা তার মন ও শরীর নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সে তখন মানসিকভাবে স্থির ছিল না। হেফাজতে থাকাকালীনও সে বারবার পুলিশের কাছে জানতে চায় তার মা কি এখনও বেঁচে আছে।
আদালত টনিকে হত্যার বদলে ম্যানস্লটারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাঁকে ব্রডমুর মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই সময় টনির দিদিমা নিনি ডালি ও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁকে আমেরিকায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। তবে টনির বাবা ব্রুকস বেকেল্যান্ড প্রকাশ্যে বলেন, তাঁর ছেলে আবারও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।
১৯৮০ সালে বিতর্কিত সিদ্ধান্তে টনিকে ব্রডমুর থেকে মুক্তি দিয়ে নিউইয়র্কে ৮৭ বছর বয়সি দিদিমা নিনি ডালির তত্ত্বাবধানে পাঠানো হয়। পরে ব্রডমুরেরই এক বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেন, এই মুক্তি ছিল গুরুতর ভুল। আমেরিকায় পৌঁছানোর মাত্র ছয় দিনের মাথায় টনি দিদিমার সঙ্গে ইংল্যান্ডে ফোন করার বিষয় নিয়ে তীব্র ঝগড়ায় জড়ায় এবং সেই ঝগড়া রক্তাক্ত পরিণতি নেয়। টনি নিনিকে আটবার ছুরি দিয়ে ঘাত করে। পুলিশ এলে সে বলে, “ও মরবে না।” আরও ভয়াবহভাবে, সে জানায় যে দিদিমার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল এবং তার মতে, তাকে মেরে ফেলাই নাকি “দয়ালু কাজ” হতো। আশ্চর্যজনকভাবে নিনি ডালি এই হামলা থেকেও বেঁচে যান।
এই ঘটনার পর টনিকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়ে নিউইয়র্কের রাইকার্স আইল্যান্ডে পাঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, জেলেও সে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু ১৯৮১ সালের ২০ মার্চ বিকেল সাড়ে তিনটেয় টনিকে তার সেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মাথায় শক্ত করে বাঁধা ছিল একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ। তদন্তকারীরা আজও নিশ্চিত হতে পারেননি এটি আত্মহত্যা ছিল, না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
এই ঘটনা দেখিয়ে দেয়, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থ কোনওভাবেই মানসিক অসুস্থতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিকৃত পারিবারিক সম্পর্কের ভয়াবহ পরিণতি ঠেকাতে পারে না।
