আজকাল ওয়েবডেস্ক: ফ্যাশন দুনিয়ায় অস্থিরতা ও ক্ষণস্থায়ী প্রবণতা থাকলেও, এমন কিছু স্রষ্টা রয়েছেন যাঁরা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জর্জিও আরমানি, যিনি মিলানে ৯১ বছর বয়সে পরলোকগমন করলেন। আধুনিক ফ্যাশনকে যে নতুন ভাষা, ভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গি তিনি দিয়েছিলেন, তা আজ স্বাভাবিক বলে মনে হলেও, প্রায় পাঁচ দশক আগে সেটাই ছিল এক বিপ্লব।

সরল অথচ শক্তিশালী নকশাই ছিল তাঁর ইউএসপি। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে স্বাস্থ্য ও ফিটনেস নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে সচেতনতা গড়ে উঠেছিল, আরমানির নকশা তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল নিখুঁতভাবে। তাঁর তৈরি স্যুট ও জ্যাকেট ছিল শরীর সচেতন, পরতে সহজ, আবার একই সঙ্গে শক্তিশালী ও আভিজাত্যে ভরপুর। পরিধানকারীর ব্যক্তিত্বকে আড়াল না করে বরং তুলে ধরাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

একেবারে সাধারণ পরিবার থেকে ফ্যাশন দুনিয়ার  শীর্ষে উঠে এসেছিলেন তিনি। ১৯৩৪ সালে ইতালির ছোট শহর পিয়াচেঞ্জা–তে জন্ম আরমানির। প্রথমে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ভাগ্যের টানে তিনি ফ্যাশন জগতে প্রবেশ করেন। মিলানের লা রিনাশেন্তে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে উইন্ডো ড্রেসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু, তারপর ১৯৬১ সালে যোগ দেন নিনো চেরুতির টেক্সটাইল কারখানায়। এখান থেকেই জন্ম নেয় তাঁর অনন্য স্টাইল—কঠোর ইতালিয়ান টেইলারিংয়ের ভেতর থেকে “স্টাফিং” বের করে এনে দেন নরম, সহজ, আধুনিক রূপ।

এরপরেই নিজের ব্র্যান্ডের সূচনা করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে স্থপতি ও সঙ্গী সের্জিও গালেওত্তির অনুপ্রেরণায় আরমানি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ফ্যাশন হাউস। গালেওত্তির অকালমৃত্যু (১৯৮৪) পর্যন্ত তিনি ছিলেন আরমানির ব্যবসায়িক সঙ্গী। মহিলাদের জন্য পুরুষদের টেক্সটাইল ব্যবহার করে তৈরি পোশাক, আবার পুরুষদের পোশাকে নরম ফ্যাব্রিক ও সিলুয়েট—এই দ্বৈত নতুনত্বে ফ্যাশন জগত চমকে ওঠে। ১৯৮০-এর দশকে অফিসকেন্দ্রিক নারীদের শক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে আরমানির পোশাক।

আরও পড়ুন: রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিক্রি বেড়ে গেছে 'ওই সমস্ত জিনিসের', বিস্ময়কর মন্তব্য উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আন্না সিভিলিয়োভার!

১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র 'আমেরিকান জিগোলো'–তে রিচার্ড গিয়ারের জন্য আরমানি পোশাক তৈরি করেন। সেই থেকেই হলিউডে তাঁর অবস্থান অটল হয়। লাল কার্পেটে তারকাদের সাজাতে আরমানির অবদান এতটাই গভীর ছিল যে ১৯৯০ সালের অস্কারকে শিল্পপত্রিকা উইমেন’স ওয়্যার ডেইলি নাম দিয়েছিল “দ্য আরমানি অ্যাওয়ার্ডস।” ১৯৮৮ সালে বেভারলি হিলসে প্রথম বুটিক খোলেন তিনি এবং সেই সময় আমেরিকার সমাজসেবী ওয়ান্ডা ম্যাকড্যানিয়েল–কে যুক্ত করেন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর মাধ্যমে আরমানি হলিউডের প্রভাবশালী মহলে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৯৮৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মিলানের ভিয়া বর্গোনুভোর আরমানি প্যালাজো ছিল একাধারে তাঁর বাড়ি ও র‍্যাম্প শো-এর কেন্দ্র। পরে তিনি ব্র্যান্ডকে প্রসারিত করেন হোটেল, স্পা, রেস্তরাঁ, প্রসাধনী, জুয়েলারি, আসবাব থেকে শুরু করে চকোলেট পর্যন্ত। ২০০০ সালে নিউইয়র্কের গুগেনহাইম মিউজিয়াম–এ তাঁর ২৫ বছরের ফ্যাশন যাত্রার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী বিপুল সাড়া ফেলে। “আনস্ট্রাকচার্ড জ্যাকেট” থেকে লাল কার্পেটের গ্ল্যামার—প্রতিটি ক্ষেত্রে আরমানির ছাপ আজও স্পষ্ট। তাঁর সরল অথচ রুচিশীল নকশা প্রমাণ করে দিয়েছে, ফ্যাশন মানে কেবল বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, বরং ব্যক্তিত্ব ও স্বাচ্ছন্দ্যের সমন্বয়। জর্জিও আরমানির মৃত্যুতে ফ্যাশন দুনিয়া হারাল এক কিংবদন্তি, যাঁর প্রভাব আগামী প্রজন্মের মধ্যেও অটুট থাকবে।