আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কারণে ভারতকে বাড়তি শুল্ক দিয়ে শাস্তি দিলেও চীনের বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্বীকার করেছেন, চীনা রিফাইনারিগুলোর ওপর “সেকেন্ডারি স্যাংশন” আরোপ করলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

চীনের বিরুদ্ধে কঠোর হলে তেলের দাম বাড়বে

১৭ আগস্ট ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুবিও বলেন— “যদি চীনের মতো দেশে সেকেন্ডারি স্যাংশন আরোপ করা হয়, তারা রাশিয়ার তেল পরিশোধন করে বিশ্ববাজারে ফের বিক্রি করবে। এতে ক্রেতারা বাধ্য হয়ে বেশি দামে তেল কিনবে, অথবা বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।”
তিনি জানান, ইউরোপীয় দেশগুলোও এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। “যখন আমরা চীন ও ভারতের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিনেট প্রস্তাব আলোচনা করছিলাম, তখন কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ স্পষ্ট জানায় যে তারা এতে অসন্তুষ্ট,” রুবিও যোগ করেন।

ভারতের ক্ষেত্রে “কঠোর” অবস্থান

তবে ভারতের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন বেশ আক্রমণাত্মক। ফক্স রেডিওতে দেওয়া আরেক মন্তব্যে রুবিও বলেন, রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানি ক্রয় “ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে” এবং এটি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে “একটি বিরক্তির কারণ”। যদিও তিনি এটিও স্বীকার করেন যে, ভারতের বিশাল জ্বালানি চাহিদা রয়েছে এবং সস্তা হওয়ায় দেশটি রাশিয়ার তেল কিনছে। “রাশিয়ান তেল বিশ্ববাজার দামের চেয়ে কমে পাওয়া যায় নিষেধাজ্ঞার কারণে,” তিনি বলেন।

আরও পড়ুন: ভারত–পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র: মার্কো রুবিও

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছেন। হোয়াইট হাউস সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি নয়াদিল্লি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে তবে সেকেন্ডারি স্যাংশন আরোপের কথাও ভাবা হতে পারে।

দ্বৈত নীতি ও সমালোচনা

তবে সমালোচকরা বলছেন, চীন ব্যাপক পরিমাণে রাশিয়ার তেল আমদানি চালিয়ে গেলেও ওয়াশিংটন তাদের ক্ষেত্রে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে ভারতের ওপর চাপ আরোপকে তাঁরা “কপটতা” বলেই অভিহিত করছেন। নয়াদিল্লি স্পষ্ট জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের জ্বালানি বাণিজ্যে কোনো বিরতি আসেনি।

ট্রাম্প–পুতিন বৈঠকের প্রেক্ষাপট

এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে ট্রাম্প–পুতিনের আলাস্কা বৈঠকের পর। তিন ঘণ্টার সেই বৈঠকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির কোনো অগ্রগতি না হলেও ট্রাম্প আলোচনাকে “১০/১০ প্রোডাকটিভ” আখ্যা দেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, আপাতত সেকেন্ডারি স্যাংশন চাপানোর ইচ্ছা নেই। “এখন করলে ওদের জন্য তা ভয়াবহ হবে। হয়তো দুই–তিন সপ্তাহ পর এ নিয়ে ভাবতে পারি,” মন্তব্য করেন তিনি।

বৈঠকের আগে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, ভারতের ওপর তাঁর আরোপিত শুল্ক রাশিয়াকে “দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা” হারানোর ভয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। তবে নয়াদিল্লি এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে জানায়, তাদের রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে।রুবিওর মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বৈশ্বিক বাজারে তেলের দামের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে তারা একের পর এক চাপ প্রয়োগ করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওয়াশিংটনের অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে— রাশিয়াকে চাপ দিতে গিয়ে কি যুক্তরাষ্ট্র আসলে দ্বৈত নীতি অবলম্বন করছে?

ভারতের তেল নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে সমালোচনা উঠেছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হলো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা। নয়াদিল্লি বারবার বলেছে, তাদের প্রথম দায়িত্ব হলো দেশের মানুষের জন্য স্থিতিশীল ও সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলেও, ভারত সস্তায় রুশ তেল কিনে তা পরিশোধন করে দেশের ভেতরে ব্যবহার করছে এবং কিছুটা অংশ আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এর ফলে ভারতীয় অর্থনীতি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে।

অন্যদিকে, ওয়াশিংটন মনে করে এই নীতি ইউক্রেন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি, রাশিয়া থেকে সস্তা তেল কেনা কোনোভাবেই রাজনৈতিক সমর্থন নয়, বরং খাঁটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন। নয়াদিল্লি একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকেও তেল কিনে বহুমুখী উৎস বজায় রাখছে। ফলে ভারতের তেল নীতি আসলে “ভারসাম্য রক্ষা”র কৌশল, যেখানে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।