আজকাল ওয়েবডেস্ক : আপনি কি কখনও ভেবেছেন, ক্যান্সার কীভাবে শুরু হয়? কিংবা কেন কিছু মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য।
আমাদের শরীর তৈরি হয়েছে ট্রিলিয়ন সংখ্যক কোষ দিয়ে। প্রতিটি কোষ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে—তারা জন্মায়, কাজ করে, এবং যখন পুরনো বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন মরেও যায়। নতুন কোষ পুরনোদের জায়গা নেয়, আর এই চক্র নিয়মিতভাবে চলে।
আরও পড়ুন: সোনা নাকি এসআইপি? বিনিয়োগের দিকে কোনটি বেশি লাভজনক
কিন্তু ক্যান্সার এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায়। কিছু কোষ হঠাৎ করে আচরণ বদলে ফেলে। তারা আর নিয়ম মানে না—উল্টে অযথা বাড়তে থাকে, বিভাজিত হতে থাকে। এই অবাধ কোষগুলো অনেক সময় টিউমার বা গাঁট তৈরি করে (তবে সব ধরনের ক্যান্সারে টিউমার হয় না; যেমন: লিউকেমিয়া, যা রক্তের ক্যান্সার, সেটি সাধারণত কঠিন টিউমার তৈরি করে না)। ক্যান্সার মূলত একটি জেনেটিক রোগ। এর মানে এই নয় যে এটা সবসময়ই বংশগত, বরং এটা কোষের ভিতরের ডিএনএ-তে পরিবর্তনের (mutation) কারণে হয়। এই পরিবর্তনগুলোর উৎস হতে পারে:
হঠাৎ বা এলোমেলো ভুল: কোষ বিভাজনের সময় মাঝেমধ্যে ডিএনএ কপি করার সময় ভুল হয়।
বাহ্যিক ক্ষতি: ধূমপান, অতিরিক্ত সূর্যালোক (UV রশ্মি), বা ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শ
বংশগত জিন: কিছু মানুষ জন্মসূত্রেই নির্দিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত জিন নিয়ে জন্মায়, যা তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়—তবে এটা তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়।
একটি স্বাভাবিক কোষ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সাধারণত সে নিজেই মরতে থাকে (এটাকে বলে apoptosis), অথবা বিভাজন বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু ক্যান্সারের কোষ এই সংকেত উপেক্ষা করে, এবং লাগাতার বিভাজিত হয়ে অস্বাভাবিক কোষের বড় দলে পরিণত হয়।
এই কোষগুলো শুধু বাড়তেই থাকে না, বরং তারা আশপাশের টিস্যুতে ঢুকে যেতে পারে। ইমিউন সিস্টেম থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে। নিজেদের জন্য রক্তনালিও তৈরি করতে পারে (যাতে পুষ্টি পায় এবং বেড়ে উঠতে পারে)। এমনকি শরীরের অন্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে (metastasis বলা হয়)

তাহলে কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় কেন, আর কেউ হয় না?
উত্তরটা হলো: জীবনধারা, পরিবেশ, জিন এবং কখনও স্রেফ ভাগ্য—এই চারটি উপাদানের সমন্বয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), CDC, NIH এবং অন্যান্য গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে প্রধান ক্যান্সার ঝুঁকি ফ্যাক্টরগুলো হলোঃ
তামাক ব্যবহার: বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের ১ নম্বর প্রতিরোধযোগ্য কারণ। ফুসফুস, মুখ, গলা, মূত্রথলি সহ অনেক ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
অ্যালকোহল : নিয়মিত বেশি মদ্যপানে মুখ, গলা, যকৃত, স্তন, ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: বেশি প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া, কম ফলমূল ও সবজি খাওয়া এবং ব্যায়াম না করায় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়েছ
UV ও আয়নাইজিং রেডিয়েশন: সূর্যের অতিরিক্ত UV রশ্মি = চর্ম ক্যান্সারের বড় কারণ। আয়নাইজিং রেডিয়েশন (যেমন কিছু মেডিকেল স্ক্যান) থেকেও ঝুঁকি থাকে।
পরিবেশগত বা কর্মস্থলজনিত সংস্পর্শ: অ্যাসবেস্টস, কিছু রাসায়নিক পদার্থ ও বায়ুদূষণ—বিশেষ করে কারখানায় কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য—ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ায়।
দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ: কিছু ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী ক্যান্সারের জন্য দায়ী। যেমন, হেপাটাইটিস B ও C → যকৃত ক্যান্সার। HPV (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস) → জরায়ুমুখ ও অন্যান্য ক্যান্সার। হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি → পাকস্থলীর ক্যান্সার। এপস্টিন-বার ভাইরাস (EBV) → বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার। WHO জানায়, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ১৩% ক্যান্সার সংক্রমণ-জনিত ছিল।
পারিবারিক ইতিহাস ও জিনগত প্রভাব: যদি পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। বয়স যত বাড়ে, তত বেশি সময় ধরে কোষের মধ্যে জেনেটিক পরিবর্তন জমতে থাকে। বয়সের সঙ্গে শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ ধ্বংস করার ক্ষমতাও কমে যায়।
ক্যান্সার সম্পর্কে জানা মানে আতঙ্কিত হওয়া নয়—সচেতনতা মানেই সুরক্ষা। অনেক ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য, এবং আগেভাগে ধরা পড়লে চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়। সুস্থ জীবনযাপন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং ঝুঁকির বিষয়গুলো জানলেই আপনি থাকবেন অনেকটা এগিয়ে।
