আজকাল ওয়েবডেস্ক: তিন দশকেরও বেশি সময় পর এক বড় নীতিগত পরিবর্তনের পথে হাঁটছে চিন। ক্রমাগত কমে আসা জন্মহার ঠেকাতে এবার গর্ভনিরোধক পণ্যের উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কন্ডোম-সহ বিভিন্ন গর্ভনিরোধক সামগ্রীর উপর ১৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে চিনা ক্রেতাদের।

ডিসেম্বর ২০২৪-এ অনুমোদিত সংশোধিত ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স আইন অনুযায়ী এই কর কার্যকর হবে। নতুন আইনে কৃষিপণ্য, চিকিৎসা পরিষেবা, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণমূলক কিছু পরিষেবাকে করমুক্ত তালিকায় রাখা হলেও, আশ্চর্যজনকভাবে সেই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী। ১৯৯৩ সাল থেকে যা সম্পূর্ণ করমুক্ত ছিল। ব্লুমবার্গ এই তথ্য জানিয়েছে।

এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় এসেছে, যখন চিন  গভীর জনসংখ্যাগত সংকটের মুখে। জন্মহার কমে যাওয়ার প্রভাব ইতিমধ্যেই দেশের অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও সামাজিক কাঠামোর উপর পড়তে শুরু করেছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৭৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চিন  কঠোরভাবে কার্যকর ছিল এক সন্তান নীতি। সেই সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কন্ডোম ও অন্যান্য গর্ভনিরোধকের ব্যবহার উৎসাহিত করা হতো। জন্মনিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে জরিমানা, চাকরি ও রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। পাশাপাশি ব্যাপক হারে নির্বীজন, গর্ভপাত এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহারের ঘটনাও ঘটেছে।

সেই প্রেক্ষাপটে কন্ডোম ও গর্ভনিরোধকের উপর কর প্রত্যাহার ছিল রাষ্ট্রীয় নীতিরই অংশ। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বদলে চীন আজ জনসংখ্যা হ্রাসের মুখোমুখি।

জন্মহার বাড়াতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে চিনা সরকার। একাধিক প্রদেশে নবজাতকের জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় বা চিকিৎসাগত কারণ ছাড়া গর্ভপাত নিরুৎসাহিত করার দিকেও প্রশাসন নজর দিচ্ছে।

একই সঙ্গে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, প্রবীণদের সেবা প্রতিষ্ঠান এবং বিবাহ সংক্রান্ত পরিষেবার উপর ভ্যাট তুলে নেওয়া হয়েছে যাতে পরিবার গঠনকে উৎসাহ দেওয়া যায়। তবে গর্ভনিরোধকের উপর কর বসানোর সিদ্ধান্ত সামাজিক স্তরে বিতর্ক উসকে দিয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চিনে জন্ম নিয়েছে মাত্র ৯.৫৪ মিলিয়ন শিশু। যেখানে এক দশক আগেই, এক সন্তান নীতি উঠে যাওয়ার ঠিক পরেই জন্ম হয়েছিল প্রায় ১৮.৮ মিলিয়ন শিশুর।

২০২৪ সালে প্রতি হাজার জনে জন্মহার নেমে এসেছে মাত্র ৬.৭৭-এ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্নের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চিনের  মোট উর্বরতা হার ছিল মাত্র ১.০- যেখানে জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজন ২.১।

জাতিসংঘের পূর্বাভাস আরও উদ্বেগজনক। ২১০০ সালের মধ্যে চিনে  সন্তান ধারণে সক্ষম মহিলার  সংখ্যা (১৫–৪৯ বছর বয়সি) দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গিয়ে একশো মিলিয়নের নিচে নেমে আসতে পারে।

জনসংখ্যাবিদদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চিনকে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হবে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী সঙ্কুচিত হবে, অথচ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে দ্রুতগতিতে। এর ফলে পেনশন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও উৎপাদনশীলতা- সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ বাড়বে।

গর্ভনিরোধকের উপর কর আরোপ আদৌ জন্মহার বাড়াতে পারবে কি না, নাকি তা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জনস্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই প্রশ্ন এখন ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।