আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২০ সালের কোভিড-১৯ অতিমারির সূচনালগ্নে রাজধানী দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে অনুষ্ঠিত তবলিঘি জামাতের জমায়েতকে ঘিরে দেশজুড়ে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরকার, প্রশাসন এবং একাংশের মিডিয়া সম্মিলিতভাবে এই ধর্মীয় জমায়েতকে ‘সুপার স্প্রেডার’ বলে চিহ্নিত করে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক পরিকল্পিত ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করে। 'করোনা জেহাদ', 'বায়ো জেহাদি', 'মারকাজ ভাইরাস' প্রভৃতি ঘৃণাপূর্ণ শব্দ ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সংবাদমাধ্যমে, যা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একপ্রকার সামাজিক গণপিটুনির জন্ম দেয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিল্লি পুলিশ ৭০ জন ভারতীয়র বিরুদ্ধে ১৬টি এফআইআর দায়ের করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি, মহামারী রোগ আইন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ও বিদেশি আইনের অধীনে অভিযোগ আনে। তাঁদের অপরাধ — তাঁরা বিদেশি তবলিঘি সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছেন। অথচ গতকাল (১৭ জুলাই) দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি নীনা বানসল কৃষ্ণ সংক্ষেপে জানিয়ে দেন, “চার্জশিট বাতিল করা হলো।” আদালত মনে করেছে, আশ্রয় দেওয়া অপরাধ নয়, এবং তাতে কোভিড বিধি ভঙ্গের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আরও পড়ুন: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের বেআইনি ঘোষণায় চাঞ্চল্য! ৮ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিলেন আন্দোলনকারীরা
এই রায়ের পর আবারও সামনে উঠে এল ২০২০ সালের সেই ‘ধর্মীয় উন্মত্ততা’ এবং রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তবলিঘি জামাতের জমায়েতকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘সুপার স্প্রেডার’ বলা হয়েছিল, যদিও একই সময়ে বহু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জমায়েত হয়েছে যার দায় সরকার কখনও নেয়নি। সেই সময় দেশজুড়ে মুসলিমদের লক্ষ্য করে হ্যাশট্যাগে ট্রেন্ড চালানো হয়েছিল — “করোনা জেহাদ”, “মারকাজ ভাইরাস” ইত্যাদি নামে। মূলধারার একাধিক সংবাদমাধ্যমও এই বিদ্বেষ প্রচারে অংশ নেয়।
আসামিপক্ষ আদালতে যুক্তি দেয়, বিদেশি নাগরিকরা যারা মসজিদে বা বাসায় ছিলেন, তাঁরা নিরুপায় অবস্থায় সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেহেতু হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। আদালতও শুনানিতে পুলিশের কাছে প্রশ্ন রাখে — এমন পরিস্থিতিতে ওই মানুষদের জন্য বিকল্প কী ছিল?
ট্রায়াল কোর্ট অনেক ক্ষেত্রে চার্জশিট গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল ‘ডাবল জিওপার্ডি’-র যুক্তিতে। পাশাপাশি, রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন ধর্মীয় জমায়েত বা রাজনৈতিক সমাবেশের বিরুদ্ধে নীরব থেকেছে, তখন শুধুমাত্র একটি মুসলিম জমায়েতকে নিশানা করা রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতদুষ্টতার ইঙ্গিত দেয় বলেই মত অনেক মানবাধিকার সংগঠনের।
এই রায় শুধু ৭০ জন নিরপরাধ ভারতীয়র আইনি জটিলতা থেকে মুক্তির ঘোষণা নয় — এটি একটি রাজনৈতিক সময়ের ন্যায়বিচার। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত মনে করিয়ে দিল, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দোষারোপ করা এবং রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে একটি গোষ্ঠীকে নিশানা করা নৈতিক ও সাংবিধানিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই রায় আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় — আমরা কি আসলেই এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে আচরণ করতে পারছি? কোভিডের মতো বৈশ্বিক মহামারিকেও কি আমরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণার হাতিয়ার করে তুলেছি? এবং আজ, যখন আদালত এই সমস্ত মামলাকে ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দিল, তখন আমাদের সমাজ, প্রশাসন এবং মিডিয়ার কাছে আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে সামনে উঠে এল।
