আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন ভোটার যাচাইকরণ অভিযানে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে দেশজুড়ে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে একদিকে কমিশনের প্রশাসনিক ত্রুটি, অন্যদিকে নাগরিকদের হতাশা—দুটোই মিলিয়ে প্রক্রিয়াটি এখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, এই তথাকথিত ‘Special Intensive Revision (SIR)’ আসলে ভোটারদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার এক “গোপন হাতিয়ার”।

নাগরিকদের অভিজ্ঞতায় অসন্তোষের ঝড়

ওড়িশার সাম্বলপুরের বাসিন্দা, বর্তমানে নিউ টাউনের বাসিন্দা সফটওয়্যার পেশাজীবী জগীতা পান্ডা রবিবার (৯ নভেম্বর) কাটালেন এক প্রশাসনিক গোলকধাঁধায়। নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী ভোটার কার্ডে নিজের মোবাইল নম্বর লিঙ্ক করতেই গিয়ে তিনি পড়লেন জটিল জালে। “ফর্ম জমা দেওয়ার পর রেফারেন্স নম্বর মেলে, কিন্তু সেটি ব্যবহার করার জায়গা কোথাও নেই—এ যেন চাবি আছে, কিন্তু তালা নেই,” বলেন জগীতা।

দক্ষিণ কলকাতার চিকিৎসক অর্জুন দাসগুপ্তর অভিজ্ঞতাও কম কষ্টকর নয়। একটিমাত্র ওটিপি (OTP) মেলেনি বলে তাঁর আবেদন বাতিল করা হয়। “এক মাসে যদি কোটি কোটি আবেদন যাচাই করা হয়, ত্রুটি তো হবেই,” মন্তব্য তাঁর।

উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির আর এক চিকিৎসক শোভন দাসের সমস্যা আরও পুরনো। “দশ বছর আগে ভোটার আইডিতে বানান ভুল সংশোধন করেছিলাম, কিন্তু কমিশনের সার্ভারে আজও পুরনো নামই রয়ে গেছে,” বলেন তিনি। ফলে আবার সেই পুরনো সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হচ্ছে।

বিদেশ থেকেও আসছে উদ্বেগের সুর। পোল্যান্ডের ক্রাকোভে থাকা সহেলি পাল জানান, জলপাইগুড়িতে তাঁর মায়ের ভোটার যাচাইকরণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অন্যদিকে কলকাতায় তাঁর আত্মীয়দের পরিবার “২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নিজেদের নামই খুঁজে পাচ্ছেন না।”

রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া

এই প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা এখন রাজনীতিতেও উত্তাপ বাড়াচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ নভেম্বর সাংবাদিক বৈঠকে এই প্রক্রিয়াকে আখ্যা দেন “সুপার ইমার্জেন্সি” হিসেবে। তাঁর কথায়, “যেভাবে ২০১৬ সালে ‘নোটবন্দি’ হয়েছিল, এবার হচ্ছে ‘ভোটবন্দি’। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার এক ষড়যন্ত্র চলছে।”

তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, গত কয়েক সপ্তাহে এই প্রক্রিয়া নিয়ে মানসিক চাপে অন্তত ডজনখানেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, “কেন্দ্র সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে এবং নির্বাচন কমিশন তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।”

দক্ষিণেও একই ছবি

তামিলনাড়ুতেও একই চিত্র। চেন্নাইয়ের ফিজিক্যাল ট্রেনার টি. রাকেশ বলেন, “আমাদের এলাকায় অনেকেই কেবল তামিলে ছাপানো ফর্ম পেয়েছেন। বলা হয়েছে ইংরেজিতে লিখলেও চলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অফিসার সেটি গ্রহণ করবেন কি না, তা নিয়ে নিশ্চয়তা নেই।” তিনি আরও জানান, বহু বুথ পর্যায়ের কর্মী সময়ের অভাবে হাউস-টু-হাউস যাচাই না করে “হোয়াটসঅ্যাপে ফর্ম পাঠিয়ে দিচ্ছেন”, ফলে মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হচ্ছে।

ইরোদের বাসিন্দা বিজয় সিদ্ধার্থ বলেন, “আমাদের বাবা-মা বছরের পর বছর ভোট দিয়েছেন, অথচ ২০০৫ সালের তালিকায় তাঁদের নামই নেই। কমিশনের কাছে থাকা ছবিগুলো ২০ বছর আগের—কালো-সাদা, অস্পষ্ট। এই ছবি দিয়ে কীভাবে পরিচয় যাচাই হবে?” তাঁর মন্তব্য, “এ যেন তালিকা পরিষ্কারের নামে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।”

স্ট্যালিনের কড়া আক্রমণ

তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্ট্যালিন প্রক্রিয়াটিকে সরাসরি বলেছেন “রাজনৈতিক অস্ত্র”। সোমবার এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমাদের বিরোধীদের হাতে আগে ছিল আয়কর দফতর ও সিবিআই, এখন তারা ‘এস.আই.আর’-কে অস্ত্র করেছে। এটি তামিলনাড়ুতে কোনওদিন সফল হবে না।”

তিনি ফর্মের বিষয়বস্তুকেও তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “আত্মীয়দের সম্পর্ক নিয়ে অস্পষ্ট প্রশ্নে ভরা এই ফর্ম বিভ্রান্তির জট তৈরি করছে, যাতে সামান্য ভুলেই প্রকৃত ভোটারদের নাম বাদ পড়ে যেতে পারে।”

দেশজুড়ে ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযান এখন পরিণত হয়েছে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক তর্কের অঙ্গনে। নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিশ্বাস পুনর্গঠনের আগে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা—এই দুই গুণ ফিরিয়ে আনা জরুরি। নচেৎ, এই “যাচাই অভিযান” হয়তো ভবিষ্যতের নির্বাচনী আস্থাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলবে।