আজকাল ওয়েবডেস্ক: গত চার দশকে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে—এমন দাবিতে মুখর বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন দক্ষিণের দেশের সরকার। ভারত, এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, ২০২২-২৩ সালে দাবি করেছে, তাদের মাত্র ৫ শতাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু ভারতের পুষ্টি গ্রহণ সংক্রান্ত সরকারি তথ্য বলছে, এই একই সময়ে ক্ষুধা এবং অপুষ্টি উভয়ই মারাত্মকভাবে বেড়েছে, যার প্রমাণ মিলেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের নিম্ন অবস্থান থেকেই।
তবে জনসাধারণের একটা বড় অংশ, এমনকি শিক্ষিতরাও বিশ্বাস করছে সরকারপন্থী দারিদ্র্য হ্রাসের পরিসংখ্যান। তারা বলছেন, "দারিদ্র্য কমলে ক্ষুধা বাড়বে কীভাবে?" কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হওয়া উচিত—"ক্ষুধা যদি বেড়ে যায়, তাহলে দারিদ্র্য কীভাবে কমে?" কারণ, পুষ্টি গ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি ও সহজে যাচাইযোগ্য, অথচ দারিদ্র্য সংক্রান্ত হিসাবপদ্ধতি জটিল এবং যুক্তিহীন বলে বিশ্লেষকরা দাবি করছেন।
দারিদ্র্য নির্ধারণে ব্যবহৃত পদ্ধতিতে মূল সমস্যা হলো, প্রথমদিকে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করা হতো প্রতি ব্যক্তির মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের উপর ভিত্তি করে—যেমন ২২০০ ক্যালোরি গ্রামে ও ২১০০ ক্যালোরি শহরে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ভিত্তিকে বাদ দিয়ে কেবল পুরনো ব্যয় ধারা ধরে, মূল্যসুচক প্রয়োগ করে দারিদ্র্যসীমা আপডেট করা হয়। অর্থাৎ, পঞ্চাশ বছরের পুরনো ভোগবস্তুর ঝুঁড়িকেই ধরে নিয়ে সেটির বর্তমান দাম হিসাব করে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করা হয়—যা একটি যুক্তিগত ভুল, যা "fallacy of equivocation" নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন: বেড়াতে গেলে ব্যাগ গোছানো নিয়ে নাজেহাল? এই কটা টিপস মানলেই হবে মুশকিল আসান
বিশ্বব্যাংক, ভারত সরকার ও অনেক অর্থনীতিবিদ এই ভুল পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেই বছরের পর বছর ‘দারিদ্র্য হ্রাস’-এর গল্প বলে আসছেন। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এইভাবে নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ সালে ভারতের গ্রামীণ ও শহরের জন্য মাথাপিছু দৈনিক দারিদ্র্যসীমা নির্ধারিত হয়েছিল যথাক্রমে ₹৫৯ ও ₹৬৯, যা দিয়ে বাজার থেকে একদিনে মাত্র ৩ থেকে ৩.৫ লিটার জলের বোতল কেনা সম্ভব।
আশ্চর্যের বিষয়, এই অতি-নিম্ন দারিদ্র্যসীমায় যখন কোনও মানুষ ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে’ পাওয়া যায় না, তখন সেটিকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘শূন্য দারিদ্র্য’ হিসেবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এত কম দামে কেউ বেঁচে থাকার মতো খাবার বা জীবনযাপন করতে পারে না, তাই সেই সীমার নিচে কেউ ‘বেঁচে নেই’—এই অনুপস্থিতিকে ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
১৯৭৩-৭৪ সালে NSSO-এর তথ্য অনুযায়ী, গ্রামে ৫৬.৪ শতাংশ এবং শহরে ৪৯.২ শতাংশ মানুষ পুষ্টির মান পূরণ করতে পারেননি। ২০১১-১২ সালে এটি বেড়ে যথাক্রমে ৬৭ ও ৬২ শতাংশে পৌঁছায়। ‘লিকড ডেটা’ বিশ্লেষণে ২০১৭-১৮ সালে গ্রামীণ অঞ্চলে এই অনুপাতে ৮০ শতাংশ পৌঁছেছে বলে অনুমান। এরপরে সরকার ডেটা সংগ্রহের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে।
এছাড়া, যারা বলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষ ‘উন্নত খাবার’ খাচ্ছেন বলে খাদ্যশস্য গ্রহণ কমছে, তাদের ভুল ভাঙাচ্ছে তথ্য। কারণ পুষ্টি গ্রহণের হিসাব শুধু সরাসরি শস্য খাওয়া নয়, পরোক্ষভাবে প্রাণিজ পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের মাধ্যমে ক্যালোরি হিসাব করে। বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, আয় বাড়লে এই মোট ক্যালোরি গ্রহণ বাড়ে। কিন্তু ভারতে গত তিন দশকে দেখা যাচ্ছে খাদ্য ব্যয়ের উপর মাথাপিছু ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। এমনকি ২০১১-১২ থেকে সমস্ত খাতেই ব্যয় কমেছে।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মতোই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসনকে যখন বাজার থেকে আলাদা করে সরকারি সুবিধা হিসেবে তুলে ধরে, তখন দারিদ্র্য দূর হয়েছিল। কিন্তু ভারতে বাজারমুখী সংস্কারের ফলে সাধারণ মানুষের হাতে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার টাকা কমেছে। এই বাস্তবতা চেপে রেখে ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ’-এর যে কৃত্রিম গল্প বলা হচ্ছে, তা অবিলম্বে ভেঙে ফেলা প্রয়োজন—না হলে বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
