আজকাল ওয়েবডেস্ক: সিমলার পার্বত্য অঞ্চলে সম্প্রতি ঘটেছে এক নজিরবিহীন ঘটনা—একই মহিলাকে বিয়ে করলেন দুই সহোদর ভাই! হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার ট্রান্স-গিরি অঞ্চলে বসবাসকারী হাট্টি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রথা 'জোড়িদারা'-র অধীনে এই অদ্ভুত কিন্তু সামাজিকভাবে স্বীকৃত বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। ১২ জুলাই শুরু হয়ে তিন দিন ধরে চলা এই বিয়েতে কুন্নাট গ্রামের সুনীতা চৌহান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শিল্লাই এলাকার প্রদীপ ও কপিল নেগির সঙ্গে। হাজার হাজার গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই আঞ্চলিক উৎসব ছিল হাট্টি সংস্কৃতির এক জীবন্ত নিদর্শন। নাচ, গান, লোকরীতি ও খাবারের মাধ্যমে উদযাপন হয় এই বহুবিবাহ প্রথা—যা ‘দ্রৌপদী প্রথা’ নামেও পরিচিত।
কী এই ‘জোড়িদারা’?
জোড়িদারা হল ভ্রাতৃ-ভিত্তিক বহুস্বামী বিবাহ প্রথা, যেখানে এক নারী একাধিক ভাইকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। হিমাচলের ট্রান্স-গিরি অঞ্চলের হাট্টি উপজাতির মধ্যে এই প্রথা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। ভারতের ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের দ্রৌপদী ও পাণ্ডব ভাইদের উদাহরণ অনুসরণ করেই এই প্রথার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। জোড়িদারা অনুযায়ী, স্ত্রী নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী স্বামীদের সঙ্গে থাকেন—প্রতি রাত, প্রতি সপ্তাহ বা মাসভিত্তিতে। সন্তানদের যত্ন এবং অভিভাবকত্ব সমস্ত ভাই মিলে ভাগ করে নেন, যদিও আইনি দিক থেকে প্রায়শই জ্যেষ্ঠ ভাইকে পিতারূপে গণ্য করা হয়। এই যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় সন্তান, সম্পত্তি ও শ্রমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক ধরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতি।
আরও পড়ুন: ৩,০০০ বছরের পুরনো মধু এখনো খাওয়ার উপযোগী! কোথায় পাবেন জেনে নিন
কেন এই প্রথা?
পার্বত্য অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক জীবিকায় জমির খণ্ডায়ন ঠেকাতেই এই প্রথার মূল উদ্দেশ্য। এক নারীর সঙ্গে একাধিক ভাইয়ের বিবাহ পরিবারে জমি ভাগ হওয়া রোধ করে এবং সামগ্রিকভাবে সম্পত্তি অখণ্ড রাখে। ফলে পরিবারে ঐক্য বজায় থাকে, ভ্রাতৃবন্ধন শক্তিশালী হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে পুরো পরিবার লাভবান হয়।
আইন কী বলে?
যদিও ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে বহুস্বামী বিবাহ নিষিদ্ধ, হিমাচল প্রদেশ হাইকোর্ট হাট্টি জনগোষ্ঠীর এই বিশেষ সামাজিক প্রথাকে "জোড়িদারা আইন"-এর অধীনে রক্ষা দিয়েছে। এটি এখনো বৈধভাবে কিছু নির্দিষ্ট উপজাতি অঞ্চলে চলতে পারে। হাট্টি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি গ্রামে বিস্তৃত এবং সম্প্রতি এদের তফসিলি উপজাতি (Scheduled Tribe) মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। জোড়িদারা প্রথাকে এই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্বে প্রভাব
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু স্বামী বা বহু স্ত্রী প্রথার প্রচলন থাকলেও, বহুপতিত্ব অর্থাৎ একজন নারীর একাধিক স্বামী গ্রহণ করার রীতিটি অত্যন্ত বিরল। ভারত, তিব্বত, নেপাল, আফ্রিকা ও অ্যামাজনের কিছু উপজাতি অঞ্চলে এই প্রথা এখনও টিকে আছে। আফ্রিকার ইরিগও উপজাতি, কানাডার ইনুইট, চীনের হেফালাইটদের মধ্যেও ফ্রেটার্নাল পলিইয়ান্ড্রির অস্তিত্ব দেখা গেছে। প্রায়শই এটি দেখা যায় যেখানে জমি সঙ্কট, নারীসংখ্যার অভাব, অথবা দারিদ্র্যজনিত কারণে একাধিক পুরুষ এক নারীকে বিয়ে করে সংসার গড়েন। সন্তানদের সুরক্ষা, সম্পত্তির ঐক্য ও যৌথ শ্রম এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি।
আধুনিক সমাজে অবস্থান
বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নারীর অধিকারের প্রসারে এই প্রথার চর্চা অনেকটাই কমেছে। হিমাচলের ট্রান্স-গিরি অঞ্চলে গত ছয় বছরে মাত্র পাঁচটি জোড়িদারা বিবাহের নজির পাওয়া গেছে। তবে সম্প্রদায়ের বয়স্করা এবং সাংস্কৃতিক নেতারা এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। সুনীতা চৌহান নিজে জানিয়েছেন, “এই সিদ্ধান্ত একান্তই পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয়েছে। কোনও জবরদস্তি ছিল না। আমরা একসাথে সুখে থাকতে চাই।” যেখানে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে এমন বিবাহ কল্পনাও করা যায় না, সেখানে হিমাচলের পাহাড়ি গ্রামগুলোয় আজও দ্রৌপদীর গল্প বাস্তবের রূপ নিচ্ছে। এ কি শুধুই প্রথা? নাকি জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এক যুগান্তকারী সামাজিক জোগান? উত্তর খুঁজে ফিরছে সমাজবিদেরা—আলপথে, পাহাড়ে।
