আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রায় ছয় দশক আগে উত্তর কেরলের কান্নুরের বাসিন্দা, জনপ্রিয় চিকিৎসক ড. এ গোপালান নাম্বিয়ার ছেলেকে পরামর্শ বলেছিলেন, 'যদি টাকা উপার্জনের কথা ভাবো, তাহলে অন্য চাকরি খুঁজে নাও!' ড. এ গোপালান নাম্বিয়ার ছেলে রাইরু, সেই সময় সদ্য চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পথচলা শুরু হয়েছিল। পেশার শুরুতেই বাবার পরামর্শই মাথায় গেঁথে গিয়েছিল তাঁর।
ব্যস! সেই শুরু! ড. এ কে রাইরু চিকিৎসা শুরু করলেন গ্রামে। প্রথম দিন থেকেই রোগী পিছু মাত্র দুই টাকা ফি নিতে শুরু করেন। গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে দুই টাকা করে ফি নিয়ে রোগী দেখেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার অন্যথা হয়নি। তারপর থেকেই গ্রামে গ্রামে রটে যায় ড. এ কে রাইরু 'দুই টাকার ডাক্তার'।
গত রবিবার, ৩ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড. এ কে রাইরু। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বয়সজনিত কারণেই রবিবার ভোরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া কেরলে। কেঁদে ভাসিয়েছেন অগণিত গরিব, দুঃস্থরা। শোকপ্রকাশ করেছেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়ন।
কেরলের কোঝিকোড় মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন রাইরু। চিকিৎসক জীবনের শুরুতে কান্নুড়ের একটি হাসপাতালে কাজ করেন। এরপর তালাপে নিজস্ব ক্লিনিক খোলেন তিনি। ৩৫ বছর ধরে এই ক্লিনিকেই বসতেন তিনি। এলাকার সমস্ত দুঃস্থ, গরিবদের থেকে মাত্র দুই টাকা ফি নিয়ে, তাঁদের পরীক্ষা করতেন।
সাধারণত রোজ ভোরে চারটে থেকে ক্লিনিকে গিয়ে রোগী পরীক্ষা শুরু করতেন। বিকেল চারটে পর্যন্ত ক্লিনিকে থাকতেন। দিনমজুর ও শ্রমজীবীদের সময় বাঁচাতে তিনি ভোর থেকে রোগী দেখা শুরু করেন। প্রতিদিন ২০০–৩০০ রোগী পর্যন্ত দেখা ছিল তার স্বাভাবিক রুটিন। ড. রাইরু নিজেই জানিয়েছেন, দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে তিনি ১৮ লক্ষ রোগীকে দেখেছেন। এর মধ্যে শিশু থেকে বয়স্ক, সকলেই রয়েছেন।
বহু গরিব রোগীকে বিনামূল্যে দেখেছেন। বাইরের জেলা থেকে কেউ এলে পরবর্তীকালে তাঁদের থেকে ১০ টাকা ফি নিতেন। তাঁর বাবা ড. গোপালানের পথচলা শুরু হয়েছিল এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে। এক রোগীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর অসহায় অবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চিকিৎসা হবে সেবার মাধ্যম। সেই থেকে শুরু হয় আজীবন সাধারণ মানুষের জন্য দরজা খুলে রাখা এক চিকিৎসাকেন্দ্রের। তাঁর পথ অনুসরণ করেন ছেলে ড. রাইরু।
অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন ছিল ড. রাইরুর। তিনি ঘুম থেকে উঠতেন রাত ২টা ১৫ মিনিটে। প্রথমে নিজের কয়েকটি গরুর দেখাশোনা করতেন। গোয়াল পরিষ্কার করতেন। দুধ সংগ্রহ করে স্থানীয়দের মাঝে বিলি করতেন। এরপর ঠিক সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে থান মানিক্কাকাভু মন্দিরের পাশে তার সাদামাটা ক্লিনিকে রোগী দেখা শুরু করতেন। তাঁর স্ত্রী ডা. শকুন্তলা এবং একজন সহকারী ওষুধ দেওয়াসহ নানা কাজে সহায়তা করতেন তাঁকে। কোনও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রতিনিধি বা লোভনীয় প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে তিনি সর্বদা স্বল্পমূল্যের কার্যকর ওষুধ প্রেসক্রাইব করতেন রোগীদের।
ড. এ কে রাইরুর দুই সন্তান। ছেলে বালা গোপাল এবং মেয়ে বিদ্যা ভারত। ড. গোপাল ছাড়াও তাঁর দুই ভাই ড. ভেনুগোপাল ও ড. রাজগোপাল ছিলেন পরিবারে। বর্তমানে স্বাস্থ্য পরিষেবা যখন বাণিজ্যিকতায় ছেয়ে গেছে, সেই সময়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানবিক চিকিৎসার এক প্রতীক।
